শুক্রবার, ১৯ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা
প্রাক রমজান

ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রাখা

ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রাখা

যে সব ডায়াবেটিস রোগী সব ঝুঁকির কথা জেনেও রোজা রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তাদের রোজার বেশ কিছুদিন আগে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে। এর মধ্যে আছে খালি পেটে ও খাবার ২ ঘণ্টা পর (মোট ৬ বার) রক্তের গ্লুকোজ, খালি পেটে রক্তের লিপিড, লিভার, কিডনি ও হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতার পরীক্ষা এবং এইচবিএ১সি ইত্যাদি পরীক্ষা করে নিতে হবে।

 

পৃথিবীতে প্রায় ২০০ কোটি মুসলমান আছে, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৬%। বর্তমানে পৃথিবীতে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪১৫ মিলিয়ন। ২০৪০ সালে এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৬৪২ মিলিয়নে। এর মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্ক ও সুস্থ মানুষ রোজা রাখেন সাধারণত। পৃথিবীর মোট প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমানের ৩৬% ডায়াবেটিসে ভুগছেন। সে হিসাবে দাঁড়াচ্ছে, প্রতি রমজান মাসে ৯-১২ কোটি ডায়াবেটিস রোগী রোজা রাখছেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় দেখা গেছে, টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের ৪৩% এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের ৭৯% রমজান মাসে রোজা রাখেন।

রোজার সময় একজন মানুষকে ভোররাত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে হয়। ভৌগোলিক অবস্থান ও মৌসুমভেদে এ সময়কাল ১৪ ঘণ্টা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২৩ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে। আমাদের দেশে সাহরি ও ইফতারের মধ্যবর্তী সময় সর্বোচ্চ ১৬ ঘণ্টা হতে পারে। এ দীর্ঘ সময় একজন ডায়াবেটিস রোগীর না খেয়ে থাকা উচিত হবে কি না তা নিয়ে অনেক বছর ধরে বহু বিতর্ক হয়েছে। কোরআন শরিফেও রোগাক্রান্তদের রোজা রাখা থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে ( সুরা আল বাকারা : আয়াত ১৮৩-১৮৫) আর অন্য যে কোনো ধরনের অসুখের চেয়ে ডায়াবেটিস নিয়মিত ও পরিমিত খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। ডায়াবেটিস রোগীর বিপর্যস্ত বিপাকীয় তন্ত্রের কারণে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে শারীরিক নানাবিধ সমস্যা হতে পারে। কিন্তু কোনো ডায়াবেটিস রোগী যদি ধর্মীয় প্রচণ্ড আগ্রহের কারণে রোজা রাখতে চান, তবে তাকে নিষেধ করাও কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে আমরা ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রাখার ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব সতর্ক থাকার পদ্ধতি আলোচনা করব।

রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়া (হাইপোগ্লাইসেমিয়া)

খাদ্য গ্রহণে অনেকক্ষণ যাবৎ বিরত থাকলে রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ কমতে থাকে। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রাখার সময় এতটাই কমে যেতে পারে যে, তাকে হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত করতে হতে পারে। টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে এরূপ হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা ৪.৭ গুণ এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ৭.৫ গুণ বেশি।

রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া (হাইপোগ্লাইসেমিয়া)

রোজা রাখার কারণে টাইপ-১ ও টাইপ-২ উভয় ধরনের ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রেই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কিছুটা ঝুঁকি থাকে। তবে টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে তা মারাত্মক হতে পারে। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এ থেকে জীবননাশের  ঘটনাও ঘটতে পারে।

ডায়াবেটিস

কিটোঅ্যাসিডোসিস

টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের বেশ কিছু ক্ষেত্রে রক্তের গ্লুকোজ মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়া বা কিটোনবড়ি বেড়ে যাওয়ার কারণে সংকটাপন্ন অবস্থা হতে পারে। বিশেষ করে যাদের রক্তের গ্লুকোজ রোজা শুরুর আগে সঠিক মাত্রায় ছিল না।

পানিশূন্যতা ও থ্রম্বোঅ্যাম্বোলিজম : দীর্ঘ সময় পানি বা পানীয় খাদ্য গ্রহণে বিরত থাকার কারণে শরীরে পানিশূন্যতা (ডিহাইড্রেশন) দেখা দিতে পারে। আর গরম ও বেশি আর্দ্র আবহাওয়ায় পানিশূন্যতা আরও প্রকট হতে পারে। যাদের রোজা রেখে কঠোর শারীরিক শ্রম দিতে হয়, তাদেরও পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া রক্তে বেশি মাত্রায় গ্লুকোজ থাকলে শরীর থেকে পানি ও খনিজ পদার্থ বের হয়ে যাওয়ার হার অনেক বেড়ে যায়। এতে করে বসা বা শোয়া অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ালে মাথা ঘুরে যেতে পারে। বিশেষত  যাদের ডায়াবেটিসের কারণে স্নায়ুবিক সমস্যা দেখা দিয়েছে তাদের এ সময় সহসা জ্ঞান হারানো, মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া, আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া, হাড় ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি ঘটতে পারে।

ব্যবস্থাপনা : ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রাখা একান্তভাবেই তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, যা তার স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এবং তার চিকিৎসকের জন্যও তা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। প্রতিটি ডায়াবেটিস রোগীই রোজা রেখে কম বেশি ঝুঁকির আওতায় চলে আসেন।

এক্ষেত্রে করণীয় বিষয়গুলো হলো : প্রত্যেক রোজাদার ডায়াবেটিস রোগীর অবস্থা তার স্বাতন্ত্র্যসহ বিবেচনা করতে হবে। ঘন ঘন রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা দেখতে হবে। প্রতিদিন বেশ কবার (কমপক্ষে তিনবার) রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দেখতে হবে। শেষ ভাগে অবশ্যই রক্তের গ্লুকোজ দেখার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে খুব সতর্কতার সঙ্গে রক্তের গ্লুকোজ লক্ষ্য রাখতে হবে।

প্রতিদিনের খাদ্যের  পুষ্টিমাণ অন্যান্য সময়ের মতই রাখার চেষ্টা করতে হবে। স্বাভাবিক দৈহিক ওজন ধরে রাখার ব্যবস্থা রাখতে হবে। গবেষণায় দেখা যায়, ২০%-২৫% ডায়াবেটিস রোগীর দৈহিক ওজন কমে বা বাড়ে। ইফতারে চর্বি সমৃদ্ধ খাদ্য এবং তেলে ভাজা খাবার গ্রহণ করা থেকে যতটা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। কেননা এসব হজম হতে সময় লাগবে। কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীর ইফতারের পরপরই যত দ্রুত সম্ভব রক্তে গ্লুকোজ সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে। সেজন্য জটিল শর্করা জাতীয় খাবার সাহরির সময় খেতে হবে। আর ইফতারিতে সহজপাচ্য খাবার খেতে হবে। প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল খাবার খেতে হবে। সাহরির খাবার নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ঠিক আগে খেতে হবে এবং তারপর প্রচুর পানি পান করা বাঞ্ছনীয়। শারীরিক শ্রম বা ব্যায়াম স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চালানো যেতে পারে এ সময়। তবে খুব বেশি কঠোর শ্রম বা ব্যায়াম না করাই ভালো। এতে করে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। আর কঠোর শ্রম বিকাল বেলায় তো করা যাবেই না।

প্রাক রমজান মূল্যায়ন : যে সব ডায়াবেটিস রোগী সব ঝুঁকির কথা জেনেও রোজা রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তাদের রোজার বেশ কিছুদিন আগে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে। এর মধ্যে আছে খালি পেটে ও খাবার ২ ঘণ্টা পর (মোট ৬ বার) রক্তের গ্লুকোজ, খালি পেটে রক্তের লিপিড, লিভার, কিডনি ও হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতার পরীক্ষা এবং এইচবিএ১সি ইত্যাদি পরীক্ষা করে নিতে হবে।

ডা. শাহজাদা সেলিম

সহকারী অধ্যাপক, অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর