শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

‘স্ট্রোক’-মস্তিষ্কে রক্তনালির জটিলতা

‘স্ট্রোক’-মস্তিষ্কে রক্তনালির জটিলতা

ছবি : ইন্টারনেট

প্রতি ছয় সেকেন্ডে একজন স্ট্রোকে মারা যান। স্ট্রোকে অনেকেই হারাচ্ছেন কার্যক্ষমতা এবং ব্যয় হচ্ছে প্রচুর অর্থ। অপর্যাপ্ত চিকিৎসায় স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী হয়ে যাচ্ছেন শারীরিক, মানসিক ও কর্মক্ষেত্রে অক্ষম।

 

স্ট্রোকের সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন সঠিক চিকিৎসা। তাই প্রথমে রোগীকে একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্টের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালে ভর্তি করান। নিয়মিত দিনে ৩-৪ বার থেরাপি চিকিৎসা নিতে হবে অন্তত ২ থেকে ৬ মাস। মনে রাখবেন, স্ট্রোকের পর রোগীকে যত দ্রুত ফিজিওথেরাপি শুরু করা যাবে রোগী তত দ্রুত সুস্থ হবে।

 

স্ট্রোক কী?

কোনো কারণে মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে স্নায়ুকোষ নষ্ট হয়ে যাওয়াকে স্ট্রোক বলে। স্ট্রোককে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় সেরিব্রো ভাসকুলার অ্যাক্সিডেন্ট বলা হয়, যা বাংলা করলে দাঁড়ায় মস্তিষ্কের রক্তনালির দুর্ঘটনা। মস্তিষ্কের বিভিন্ন জায়গা আমাদের শরীরের বিভিন্ন কাজের জন্য নির্দিষ্ট থাকে। তাই মস্তিষ্কের কোথায়, কতটুকু আক্রান্ত, তার ওপর নির্ভর করে স্ট্রোকের ভয়াবহতা।

 

স্ট্রোক হওয়ার কারণ...

প্রধান দুটি কারণে স্ট্রোক হয়ে থাকে। মস্তিষ্কের রক্তনালিতে কোনো কিছু জমাট বাঁধলে এতে রক্তের নালিকা বন্ধ হয়ে যায় এবং মস্তিষ্কের আক্রান্ত অংশের স্নায়ুকোষগুলো অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়। এ ছাড়াও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ঘটলে উচ্চরক্তচাপও ঘটে, যেখানে ছোট ছোট রক্তনালিকা ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ হয়, মস্তিষ্কে চাপ বেড়ে যায় এবং অক্সিজেনের অভাবে এর স্নায়ুকোষগুলো মারা যায়।

 

স্ট্রোকের উপসর্গসমূহ :

হঠাৎ অতিরিক্ত মাথাব্যথা, মুখ, হাত ও পা অবশ হয়ে যাওয়া (সাধারণত শরীরের যে কোনো এক পাশ) অনেক সময় মুখের মাংসপেশি অবশ হয়ে যায়। এর ফলে লালা ঝরতে থাকে, হঠাৎ কথা বলতে এবং বুঝতে সমস্যা হওয়া, এক চোখে অথবা দুই চোখে দেখতে সমস্যা হওয়া, ব্যালেন্স বা সোজা হয়ে বসা ও দাঁড়াতে সমস্যা হওয়া, মাথা ঘোরানো এবং হাঁটতে সমস্যা হওয়া। ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ, ধূমপান, স্থূলতা, উচ্চ কলেস্টেরলের মাত্রা এবং হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। মহিলাদের ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবহার অতিরিক্ত ঝুঁকি বহন করে। মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহে কোনো বাধার সৃষ্টি হলেই মূলত ব্রেইন স্ট্রোক হয়। তবে এর কিছু লক্ষণ রয়েছে, যা নিম্নে আলোচনা করা হলো—

 

►  রোগীর মুখের এক পাশ যদি বেঁকে যায় তাহলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। সে সময় রোগী হাসতে পারেন না। ব্রেইন স্ট্রোকের প্রধান লক্ষণ মুখ বেঁকে যাওয়া।

►  একজন স্ট্রোকের রোগী তার এক হাত অথবা উভয় হাত বা পা অবশ বা দুর্বলতা অনুভব করে, যা স্ট্রোকের লক্ষণ হতে পারে। স্ট্রোকের রোগী তার হাত উপরে ওঠাতে পারেন না।

► স্ট্রোকের রোগী ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। একই প্রশ্নে নানা উত্তর দেন। এমনকি চোখে না দেখতে পাওয়া বা দেখতে অসুবিধা হওয়া।

►  কারণ ছাড়াই প্রচণ্ড মাথাব্যথা অনুভব করা। এটি মূলত রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোকের ইঙ্গিত।

►  স্ট্রোকের রোগী তার আপনজনকে চিনতে পারেন না, এমনকি নিজের নাম পর্যন্ত ভুলে যান। ডাক্তারদের ভাষায় একে শর্ট মেমোরি লস বলে। এমন অবস্থা দেখলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা নিন।

 

স্ট্রোক-পরবর্তী সমস্যা :

শরীরের এক পাশ অথবা অনেক সময় দুই পাশ অবশ হয়ে যায়, মাংসপেশির টান প্রাথমিক পর্যায়ে কমে যায় এবং পরে আস্তে আস্তে টান বাড়তে থাকে, হাত ও পায়ে ব্যথা থাকতে পারে, হাত ও পায়ের নড়াচড়া সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে কমে যেতে পারে, মাংসপেশি শুকিয়ে অথবা শক্ত হয়ে যেতে পারে, হাঁটাচলা, উঠবোস, বিছানায় নড়াচড়া ইত্যাদি কমে যেতে পারে, নড়াচড়া কমে যাওয়ায় চাপজনিত ঘা দেখা দিতে পারে, শোল্ডার বা ঘাড়ের জয়েন্ট সরে যেতে পারে।

 

স্ট্রোক থেকে বাঁচতে করণীয় :

স্বাস্থ্যসম্মত জীবন-ব্যবস্থায় এর ঝুঁকি অনেকখানি কমানো যায়। ব্লাডপ্রেসার জানা এবং নিয়ন্ত্রণ করা, ধূমপান এড়িয়ে চলা, কলেস্টেরল এবং চর্বি জাতীয় খাবার পরিহার করা, নিয়মমাফিক খাবার খাওয়া, সতর্কভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত হাঁটা বা হালকা দৌড়ান, দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রণ, মাদক না নেওয়া, মদ্যপান না করা ইত্যাদি। স্ট্রোক হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেওয়া উচিত। স্ট্রোক পুরোপুরি ভালো হয় না। রোগীকে সব সময় তত্ত্বাবধানে ও যত্নে রাখতে হয়। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি করানোর প্রয়োজন হতে পারে।

স্ট্রোকের ক্ষেত্রে প্রতিরোধই সবচেয়ে বড় সমাধান। রোগীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপির ভূমিকা অপরিসীম।

 

অধ্যাপক ডা. সিরাজুল হক

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

সর্বশেষ খবর