শুক্রবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
সুস্বাস্থ্য

শিশুর থাইরয়েডের সমস্যা

শিশুর থাইরয়েডের সমস্যা

ছবি : মঞ্জুরুল আলম

এমন কিছু অসুখ আছে, যার লক্ষণ জন্মের পর পরই বোঝা যায়। তার মানে, ওইসব অসুখ যদি কোনো শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করে ডায়াগনসিস করা যায়, তা হলে সেসব অসুখের হাত থেকে বাঁচা সম্ভব।

 

আদনান (ছদ্ম নাম)। ১ বছর ৩ মাস বয়সী রাজধানীর মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাবা-মা দুজনই শিক্ষিত এবং চাকরিজীবী। ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সে জন্মগ্রহণ করেছে। জন্মের কিছুদিন পর থেকে তার বৃদ্ধির হার কম বলে বাবা-মার মনে হচ্ছে। কিন্তু প্রথম সন্তান হওয়ার কারণে তারা একটু অনিশ্চয়তায় ছিল, এটি আসলেই কোনো সমস্যা কিনা? ৯ মাস বয়সে আদনানকে শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তার থায়রয়েড হরমোন ঘাটতিজনিত সমস্যা আছে। অসুখটি হলো হাইপোথায়রয়েডিজম। আমাদের শরীর থেকে অনেক রকম হরমোন সিক্রিশন হয়, তার মধ্যে অন্যতম থায়রক্সিন হরমোন। এই হরমোন থায়রয়েড গ্ল্যান্ড থেকে বেরোয়। থায়রয়েড হরমোন আমাদের শরীরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগে। যেমন- বুদ্ধির বিকাশ, মস্তিষ্কের বৃদ্ধি, মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ইত্যাদি। কোনো শিশুর জন্মের পরের ২ বছরের মধ্যে তার মস্তিষ্কের বিকাশ মোটামুটি সম্পূর্ণ হয়ে যায়। এই সময় থায়রয়েড হরমোনের তারতম্য থাকলে মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ও বিকাশে সমস্যা হতে পারে। হাইপোথায়রয়েডিজম থেকে একবার মস্তিষ্কে বৃদ্ধি ও বিকাশজনিত কোনো রকম সমস্যা দেখা দিলে পরবর্তীকালে এটা ঠিক হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। শরীরে থায়রক্সিন হরমোনের ঘাটতি থাকলে বা হরমোনটির কার্যকারিতায় কাক্সিক্ষত মাত্রায় না হলে বা অ্যান্টিথায়রয়েড অ্যান্টিবডির কারণে হরমোনটির প্রভাব কমে গেলে অসুখটিকে বলা হয় হাইপোথায়রয়েডিজম। সুতরাং শিশু জন্মানোর পর দেরি না করে স্ক্রিনিং টেস্ট (থায়রয়েড ফাংশন টেস্ট) করা উচিত। সাধারণত জন্মের তিন দিন পর আর সাত দিনের মধ্যে নবজাতকের স্ক্রিনিং টেস্ট করা হয়। টেস্টে থায়রয়েড হরমোনের ঘাটতি ধরা পড়লে চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া হয়। চিকিৎসা চলাকালীনও নির্দিষ্ট সময় পর পর নিয়মিত থায়রয়েড ও হরমোন পরিমাপের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। কারও কারও ক্ষেত্রে কোনো এক সময় থায়রয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে। তখন সাধারণত থায়রক্সিন ট্যাবলেট সেবন বন্ধ করে দেওয়া হয। আবার কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে আজীবনই হরমোন সেবন করে যেতে হয়।

হাইপোথায়রয়েডিজমে আক্রান্ত শিশুদের উচ্চতা ও ওজন ঠিকমতো বাড়ে না, খুব দুর্বল প্রকৃতির থাকে, কোষ্টকাঠিন্য, ত্বকের সমস্যা দেখা যায়, পেট ফুলে যায়, এমনকি চেহারায় অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। এই ধরনের লক্ষণ চেহারায় ফুটে ওঠা মানে মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে গেছে। আর একটু বড় শিশুদের হাইপোথায়রয়েডিজমের সমস্যা হলে বৃদ্ধি ঠিকমতো হয় না, বয়ঃসন্ধি আসতে দেরি হয়। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি সম্পন্ন হওয়ার পরে থায়রয়েড সমস্যা হলে চিকিৎসা করার পর সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী কোনো ক্ষতি হয় না।  হাইপারথায়রয়েডিজমের ক্ষেত্রে উল্টোটা ঘটে। তখন থায়রয়েড গ্রন্থিটির কার্যকারিতা বা হরমোনের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন রকম শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে থাকে। হাইপারথায়রয়েডিজম অসুখটি সাধারণত বড়দের বেশি হয়। হাইপারথায়রয়েডিজমে আক্রান্ত বাচ্চারা ভীষণ অস্থিরতায় ভোগে। অর্থাৎ সব সময় ছটফট করতে থাকে, ঘন ঘন জ্বরও আসতে পারে, কারও কারও ঘন ঘন পায়খানা হয়, অতিরিক্ত ঘাম হয়। একটু বেশি বয়সী শিশু হলে বুক ধড়ফড়ানির কথা বলবে এবং এরা গরম সহ্য করতে পারে না। এক্ষেত্রে অ্যান্টি-থায়রয়েড ট্যাবলেট দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। একটু বড় শিশুদের ক্রনিক হাইপোথায়রয়েডের সমস্যায় গলগন্ড হতে পারে (গলা ফুলে যায়)।

হাইপো বা হাইপারথায়রয়েডিজমে আক্রান্ত শিশুদের সঠিক চিকিৎসা করা হলে অন্য সবার মতোই শারীরিক-মানসিক বৃদ্ধি অর্জন ও পরিপূর্ণ-সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব। তবে সমস্যা শুরু হওয়ার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া জরুরি। অন্যথায় বাড়ন্ত বয়সে সমস্যাটি শিশুটিকে জীবনের প্রতিটি স্তরে ভোগাবে।

লেখক- ডা. শাহজাদা সেলিম

হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল

বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর