রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় বাস্তবায়ন ও নিরাপত্তা

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় বাস্তবায়ন ও নিরাপত্তা

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম চলছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনের দণ্ড বাস্তবায়ন করা হয়েছে। রায় বাস্তবায়ন ও বিচারাধীন মামলা নিয়ে এই মুহূর্তে দেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে একটি মহল। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও চলছে নানা আলোচনা। গতকাল রাজধানীর একটি কনভেনশন সেন্টারে রিজিওনাল অ্যান্টি টেরোরিস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট আয়োজন করে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় বাস্তবায়ন ও নিরাপত্তা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক। এতে অংশ নেন শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, আইনজীবী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।  গোলটেবিল বৈঠকের চুম্বকাংশ তুলে ধরেছেন- আহমেদ আল আমীন,  লাকমিনা জেসমিন সোমা ও তানভীর আহমেদ।

ছবি তুলেছেন : রোহেত রাজীব

মিডিয়া পার্টনার : ৭১ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ প্রতিদিন

যারা অংশ নিলেন

ড. এ কে আজাদ চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীর বিক্রম, মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক মন্ত্রী

ওয়ালিউর রহমান, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনীতিক

শাহরিয়ার কবীর, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি

গোলাম কুদ্দুছ, সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট

মে. জে. (অব.) মো. আবদুর রশীদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক

ড. এম এ হাসান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক        

ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়   

অধ্যাপক জিয়া রহমান, ক্রিমিনলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়           

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, প্রসিকিউটর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

অ্যাডভোকেট এ এম আমিনুদ্দিন, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট  

হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান, ইসলামী চিন্তাবিদ    

ব্যারিস্টার আহসান হাবীব ভূঁইয়া, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট    

সঞ্চালক :অধ্যাপক জিনাত হুদা, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

কী-নোট :

মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.)

নির্বাহী পরিচালক, রিজিওনাল অ্যান্টি টেরোরিস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ঢাকা


 

ষড়যন্ত্রকারীদের রাষ্ট্রে জায়গা হতে পারে না

 

 

অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এরপর কত যুগ চলে গেছে অথচ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কেউ কথা বলেননি। বঙ্গবন্ধুকন্যা ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। দেরিতে হলেও সেই কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং ইতিমধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে। যারা এর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তারা শুধু এই সরকারের বিরুদ্ধেই নয়, এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন। তারা রাষ্ট্রের শত্রু। বর্তমানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে চারদিকে যেসব ষড়যন্ত্র দেখতে পাচ্ছি তা অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। এই ষড়যন্ত্রকারীরা বাইরে যতটুকু না শক্তিশালী ভিতরে তারচেয়ে শক্তিশালী। তাদের শিকড় আরও গভীরে বিস্তৃত। তাই আজ আমরা যেভাবে মিলিত হয়েছি সেভাবেই আগামী দিনে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আইন মানুষের জন্য। ষড়যন্ত্রকারীদের এই রাষ্ট্রে জায়গা হতে পারে না। তারা সবাই অপরাধী।


 

দেশব্যাপী অনেক মুক্তিযোদ্ধাই হতাশ

 

 

কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রম

মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক মন্ত্রী

চারদিকে সবার কথা শুনে ভয় হচ্ছে, কখন কী হয়ে যায়! তাই বলে মাঝ সমুদ্রে এসে হাল ছেড়ে দেব না। আজ প্যালেস্টাইনে শিশুকে যখন পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে তখন অ্যামনেস্টি কিছুই বলছে না? দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, এটি আর কোনো ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ নেই। বরং পুরো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। সুতরাং আইএস বা জঙ্গি বিতর্ক নিয়ে বসে না থেকে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তা না হলে বাঘ আসছে বাঘ আসছে করতে করতে এক দিন সত্যিই বাঘ এসে যাবে। তখন আর কিছু করার থাকবে না। আমরা কঠিন পরীক্ষার মধ্যে আছি। সাপ নিয়ে খেলছি। তাই কৌশলে সাবধান হয়ে এই বিচারকার্য সম্পাদন করতে হবে। আজ দেশব্যাপী অনেক মুক্তিযোদ্ধাই হতাশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কেবল কোনো ব্যক্তি বা দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এটি উন্মুক্ত মানুষের চেতনা মনে করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে।


 

এখনই সময়, সবাইকে উজ্জীবিত করতে হবে

 

 

 

ওয়ালিউর রহমান

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনীতিক

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত কোনো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালেই আপিলের সুযোগ নেই। রিভিউয়ের সুযোগ নেই। অথচ আমাদের ক্ষেত্রে সেই সুযোগটি রাখা হয়েছে। আজ কেন বিচারকার্য দীর্ঘায়িত হচ্ছে? এর কারণ অত্যন্ত লজ্জাজনক। আন্তর্জাতিক মানের এই ধরনের ট্রাইব্যুনালে আপিলের সুযোগ রাখা একেবারেই ভুল সিদ্ধান্ত। একবার ভেবে দেখেন, এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শেষ করতে আরও কত বছর লাগবে। এখনই সময়, সবাইকে উজ্জীবিত করতে হবে। সামনের দিকে এগোতে হবে। আমাদের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কে কথা বলছে? আজ পর্যন্ত একটা বিদেশি পত্রিকায় দেখলাম না আমাদের কোনো রাষ্ট্রদূত বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ নিয়ে কোনো আর্টিকেল লিখেছেন। দরকার হলে সত্যতা ও বিচারের স্বচ্ছতা প্রমাণে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। কেবল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই নয়, স্বরাষ্ট্র এবং আইন মন্ত্রণালয়কেও এই দায়িত্ব নিতে হবে।


 

ন্যূনতম শাস্তি হওয়া উচিত মৃত্যুদণ্ড

 

 

শাহরিয়ার কবীর

ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে এই পর্যায়ে নতুন করে সাক্ষ্যগ্রহণের আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু রিভিউতে নতুন করে মামলায় শুনানির সুযোগ নেই। বিষয়টি ২ নভেম্বর আদালতে শুনানির অপেক্ষায় আছে। তারপরও দেখি বিষয়টিতে সেদিন আদালতে কী হয়। মামলায় টেকনিক্যাল কোনো ভুল থাকলে, রিভিউতে সে বিষয়ে দেখা হয়, সংশোধন করা হয়। জামায়াত এই বিচারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। একাত্তরে হত্যাকাণ্ড হয়েছে, হত্যাকারীরা বাংলাদেশের, ভিকটিমরা বাংলাদেশের, বিচারব্যবস্থা এ দেশের। আমাদের বিচারব্যবস্থা নিয়ে কথা বলার অধিকার কারও নেই। এখানে মৃত্যুদণ্ড আছে তা নিয়ে কথা বলার অধিকার কারও নেই। আমার তো মনে হয় ন্যূনতম শাস্তি হওয়া উচিত মৃত্যুদণ্ড। অথচ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর ভাষায় কথা বলছে। তাদের বোঝা উচিত এভাবে একতরফাভাবে তাদের কথা বলা উচিত নয়। শুধু জাতীয় নিরাপত্তা নয়, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা নির্বিঘ্ন হবে না যদি জামায়াতের বিচার করা না যায়।


 

বাংলাদেশকে কেউ জঙ্গি রাষ্ট্র বানাতে পারবে না

 

 

 

মে. জে. মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.)

নির্বাহী পরিচালক, রিজিওনাল অ্যান্টি টেরোরিস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ঢাকা

প্রথমত, ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের সময় আসন্ন দুই যুদ্ধাপরাধীকে বাঁচানোর জন্য বা দণ্ড কার্যকর ঠেকিয়ে রাখা ও প্রলম্বিত করার জন্য এই দুজনের প্রতি সহানুভূতিশীল সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ও দুজনের রাজনৈতিক পক্ষ থেকে পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনাগুলো ঘটানো হয়ে থাকতে পারে। রাষ্ট্র অস্থিতিশীল হলে, সরকার সংকটে পড়লে এবং জননিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লে দেশি-বিদেশি চাপে সরকার হয়তো এই দণ্ড কার্যকর করা থেকে বিরত থাকবে- এই ধারণায় জামায়াত-বিএনপি এক হয়ে এ ঘটনা ঘটাতে পারে বলে প্রবলভাবে সন্দেহ কাজ করছে তদন্তকারী সংস্থা ও বৃহত্তর জনগণের মনে। দ্বিতীয় সন্দেহের দিকটা যাচ্ছে, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ের জন্য একটি পরাশক্তি তাদের পশ্চিমা বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের যোগসাজশে সরকারের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টির জন্য কোনো চক্রান্তের আশ্রয় নিয়ে থাকতে পারে। বাংলাদেশকে কেউ জঙ্গি রাষ্ট্র বানাতে পারবে না। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকরও কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।


 

সবার নিরাপত্তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে

 

 

গোলাম কুদ্দুছ

সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট

আমরা বিচার করছি অপরাধের। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের সহযোগী মিত্ররা যে অপরাধ করেছে, তার বিচার করছি। এই বিচার করছি মানবিক ও আইনানুগ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। এই বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দেশে ও বিদেশে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে, এই ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচন এখন গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র-সরকার, ট্রাইব্যুনাল ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির ভূমিকা হতে হবে গুরুত্বপূর্ণ। বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত মামলার বাদী, সাক্ষী ও ট্রাইব্যুনালের বিচারক থেকে শুরু করে সবার নিরাপত্তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বানচালের ক্ষেত্রে সব ষড়যন্ত্র সরকারকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে। আর ট্রাইব্যুনাল দ্রুততার সঙ্গে এই বিচার প্রক্রিয়া শেষ করবেন বলে আমরা আশা করি। আমরা বিচার চাই, কিন্তু বিচার প্রতিহত করার শক্তির বিপরীতে আমরা কতটুকু ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার আছি? আমরা যারা সামাজিক শক্তি, প্রগতিশীল শক্তি, বিচার প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সরকারের পাশে তাদের দাঁড়াতে হবে।


 

বিশ্বকে জানাতে হবে তাদের মতো করে

 

 

 

ড. এম এ হাসান

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক

আজ বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়ে এসেছে দাঁড়িয়ে। এই মুহূর্তে আমরা যদি কোনো ভুল করি সেই দিন বেশি দূরে নেই যে পশ্চিমারা বলবে, আমরা গৃহযুদ্ধের মুখে। আমরা সম্ভবত সবাইকে সুস্পষ্ট করে বোঝাতে পারিনি কেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছি। জনগণকে এবং আন্তর্জাতিক মহলে এটি বোঝাতে হবে। কেননা পরিকল্পিতভাবে সরকারকে, বিচারকার্যকে তথা রাষ্ট্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করা হচ্ছে। সরকার কি পারে না লবিস্ট নিয়োগ করতে? আমরা কি পারি না বিশ্ববাসীর কাছে, যারা মুজাহিদ-নিজামীকে আলেম-ওলামা মনে করে, তাদের ভাষায় প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে? কেবল মাতৃভাষায় মিটিং-মিছিল করলে হবে না। বিশ্বকে জানাতে হবে তাদের মতো করে। আমাদের এবার আত্মরক্ষামূলক নয়, আক্রমণাত্মক হতে হবে। আর আইরিন খান চলে যাওয়ার পর থেকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এই দৈন্যদশা হলো কেন, তা আরও খতিয়ে দেখতে হবে।


 

আমরা শুধু জামায়াতে ইসলামীর বিচার করছি না

 

 

 

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ

প্রসিকিউটর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী চার বছর সময় পেয়েছেন অনেক নাটকীয়তার জন্ম দেওয়ার জন্য। প্রসিকিউটর হিসেবে তা দেখার সুযোগ আমাদের হয়েছে। তিনি এই মামলায় এখন রিভিউয়ের পর্যায়ে এসে সাক্ষ্যগ্রহণের আবেদন করেছেন। বিষয়টি বিচারাধীন রয়েছে। আদালতে বিষয়টির সুরাহা হবে। আমাদের দেশে একটি খুনের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, সেখানে ১০০ জনকে হত্যার দায়ে আমরা কাউকে যাবজ্জীবন দিতে পারি না। আমরা শুধু জামায়াতে ইসলামীর বিচার করছি না, অন্য দলের আসামিও এখানে আছে। একাত্তরের অপরাধীরা যদি জামায়াতের হয়ে থাকে তাহলে জামায়াতের বিচার হবে না তো কি হবে? আমাদের এখানে একটি ডিফেন্স ফ্রেন্ডলি ট্রায়াল হয়েছে। এই বিচার প্রক্রিয়ায় সৈয়দ কায়সার ও আবদুল আলীমকে জামিন দেওয়া হয়েছে। সেখানে সালাউদ্দিন কাদের ও মুজাহিদের বিচারের মান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের ঔদ্ধত্য দেখে আমি হতভম্ব। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে তারা কীভাবে এ কথা বলেন? অ্যামনেস্টিকে বলতে চাই, আপনারা কার টাকায় কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেন?


 

যে কোনো অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনতে হবে

 

 

মে. জে. (অব.) মো. আবদুর রশীদ

নিরাপত্তা বিশ্লেষক

এই পর্যায়ে এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তর্ক-বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। বরং এই বিচার কার্য সম্পন্নের সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যত ঝুলতে থাকবে দেশের মানুষের নিরাপত্তা ততই ঝুঁকিতে পড়বে। সম্প্রতি দেশের অভ্যন্তরে বিদেশি নাগরিক হত্যা থেকে শুরু করে যেসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেছে তার সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন বা যাদেরই সংশ্লিষ্টতা থাক না কেন এটি সরাসরি ‘ফাংশনাল ডেমোক্রেসির’ ওপর আঘাত হানছে। আজ নিরাপত্তাকে জিম্মি করে, সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রাজনীতি করা হচ্ছে। একটি স্থিতিশীল সরকারকে অস্থিতিশীল প্রমাণ করতে কিছু মানুষ তৎপর হয়ে উঠেছে। তাদের মদদ দিচ্ছে আরেকটি আন্তর্জাতিক মহল। এই দুই পক্ষ এক হয়ে কাজ করলেও তাদের স্বার্থ কিন্তু ভিন্ন। বিষয়গুলো ভেবে দেখতে হবে। সর্বোপরি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই নয়, যে কোনো অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।


 

কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ

 

 

অধ্যাপক জিনাত হুদা

সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢা.বি.

বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া যেন প্রশ্নবিদ্ধ হয় সেটাই চাইছে একটি মহল। যখন যুদ্ধাপরাধীদের আরও কয়েকটি রায় বাস্তবায়নের পথে তখন দেশ অস্থিতিশীল করে তোলা হচ্ছে। সম্প্রতি দুজন বিদেশি নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। বোমা হামলার ঘটনাও ঘটেছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাকে জিম্মি করে অপরাজনীতি করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিস্ট নিয়োগ করে বিএনপি-জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে ষড়যন্ত্র করছে। কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। যে দেশগুলো নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল করে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিয়েছে তারা বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কথা বলে কীভাবে। অ্যামনেস্টি কী মানবাধিকারের কথা বলে নাকি দানবাধিকারের কথা বলে এই প্রশ্ন উঠেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাস্তবায়নে জনমত গঠন করা প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সবাইকে নিয়ে এই ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে হবে।


 

বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক পাঠ বাধ্যতামূলক করতে হবে

 

 

অধ্যাপক মেসবাহ কামাল

ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আইএসআই তৎপর। বিষয়টি বিশেষভাবে ভেবে দেখতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য বহু আগেই হয়ে গেছে। এ নিয়ে আর বাদানুবাদের সুযোগ নেই। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে যে জাতীয় ঐকমত্য ছিল এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও সেই জাতীয় ঐকমত্য আছে। বাংলাদেশ যখন গণতন্ত্র সুসংহত করার চেষ্টা করছে, তাতে গণতন্ত্রের পশ্চিমা গডফাদাররা সন্তুষ্ট নয়। তারা এখন মানবাধিকারের ধ্বজাধারী হয়ে গেছে। এ দেশে আগে যে কোনো মূল্যে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে। জামায়াতের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। আমি ক্ষোভের সঙ্গে বলছি, একটি ট্রাইব্যুনাল ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের কুকীর্তি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করতে হবে। আমাদের টিম পাঠাতে হবে বিশ্বকে ওদের কুকীর্তি জানানোর জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক পাঠ বাধ্যতামূলক করতে হবে।


 

অপপ্রচার রোধে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংশ্লিষ্ট করা দরকার

 

 

ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ

অধ্যাপক ও পরিচালক, জাপান স্টাডি সেন্টার

যুদ্ধাপরাধীদের রায় বাস্তবায়নের সময় যত ঘনিয়ে এসেছে দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে ষড়যন্ত্রের জাল ততই বিস্তৃত হচ্ছে। সার্বিক নিরাপত্তা সংকট ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাস্তবায়ন একই সূত্রে গাঁথা। আমি নিজে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যুক্ত থেকেছি, আন্তর্জাতিক বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় এসেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তার ফিলোসফি থেকে সরে এসেছে। এটি বহিরাবরণে মানবপাচারের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন যেভাবে কাজ করে তাতে রিপোর্ট তারা দেখভাল করে। অনেক ক্ষেত্রে এই রিপোর্টগুলো কন্ডিশন হয়ে যায়। অ্যামনেস্টির দরকার ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা। সেটি না করে তারা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যা ঘটছে তা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার রোধে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংশ্লিষ্ট করা দরকার।


 

এটি আমেরিকার আরেক জিএসপি রাজনীতি

 

 

অধ্যাপক জিয়া রহমান

ক্রিমিনলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিদেশি হত্যার ঘটনা প্রথমে বিছিন্ন মনে হলেও পরবর্তীতে যখন আরেক বিদেশিকে হত্যা করা হলো তখন তা বিচ্ছিন্ন কিছু মনে হয়নি। যাবতীয় কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়েছে এর সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে জামায়াত অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। বিএনপি তাতে যুক্ত হয়েছে। অন্য আর একটি শক্তি তাদের ইন্ধন দিয়েছে। অতঃপর বিএনপির লবিস্ট নিয়োগের চুক্তি ফাঁস হয়েছে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছে। এই সবকিছুরই একটি ‘কানেকশান’ আছে। তাভেলা হত্যার পর আমেরিকাই প্রথম আইএস সংশ্লিষ্টতার কথা উচ্চারণ করেছে। মার্কিন অ্যাম্বাসেডর বার্নিকাট বলেছেন, তারা প্রয়োজনে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবেন। এটি আমেরিকার আরেক জিএসপি রাজনীতি। যেহেতু পরশু রায়, সেহেতু এমন অসংখ্য ষড়যন্ত্র আসবেই। বিএনপি-জামায়াত যেমন লবিস্ট ভাড়া করে রাজনীতি করছে তেমনি আমাদেরও জনমত গঠনে আরও কঠোরভাবে এবং দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে হবে।


 

অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে

 

 

 

অ্যাডভোকেট এ এম আমিনুদ্দিন

আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট 

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। কয়েকটি রায় এসেছে। আইনে এই রায়গুলো কার্যকরের বিধান রয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে যে রায় এসেছে, সে রায়ের রিভিউ করতে চায়। আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো কীভাবে এই রায় নিয়ে বক্তব্য দেয়। প্রত্যেকটি দেশ পরিচালিত হয় তার সংবিধান অনুযায়ী। একটি দেশের অন্য দেশের সংবিধানের প্রতি সম্মান জানানো উচিত। অ্যামনেস্টি কীভাবে বাংলাদেশের সংবিধানের বিরুদ্ধে কথা বলে? আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বিচারের কথা বলে! অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দৃষ্টতা দেখে স্তম্ভিত হই। বিএনপি-জামায়াত এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। তাদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। দুটি মামলার রিভিউ হবে। সে সূত্র ধরেই দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। যেন রায় বাস্তবায়ন করতে না পারে। এই সংকট মোকাবিলায় সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।


 

ফকার ছেলে সাকাকে হালকা একটু ডলা দেওয়া হয়েছে

 

 

ব্যারিস্টার আহসান হাবীব ভূঁইয়া

আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট

যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ড প্রদান করা হয়েছে। মানবতাবিরোধীরা সুপ্রিমকোর্টে আপিল করতে পারে না। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ, পাশাপাশি পাকিস্তানের সাক্ষী চেয়েছেন। এই নজির আমাদের সাবকন্টিনেন্টে কেন সারা পৃথিবীর কোথাও নেই। এর আগে দেখেছি, কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ে পাকিস্তান পার্লামেন্টে শোক প্রস্তাব এনেছে। এবার সাকা চৌধুরী পাকিস্তানের সাক্ষী চেয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন একাত্তরে যুদ্ধাপরাধে তার সংশ্লিষ্টতা ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এক খবরে বলা হয়েছিল, ‘ফকার ছেলে সাকাকে হালকা একটু ডলা দেওয়া হয়েছে’। এরপর যে ডাক্তার তাকে চিকিৎসা করেছিলেন তিনিও ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এখন ২০১৫ সালে পাকিস্তানি এসে সাকার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে, এটা শুধু সিনেমাতেই দেখা যায়। মানবতাবিরোধীদের মানবতার কথা বিবেচনা করেই রিভিউ, আপিল করতে পারছেন। পাকিস্তানি সাক্ষ্য চেয়ে যুদ্ধাপরাধী এটাই প্রমাণ দিল তারা স্বাধীনতাবিরোধী।


 

কোরআনে হত্যাকারীদের বিচারের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে

 

 

হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান

ইসলামী চিন্তাবিদ

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরে যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে, হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিয়ে তারা হত্যাকারীদের পুনর্বাসিত করেছে। কোরআনে হত্যাকারীদের বিচারের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখের কথা বলা হয়েছে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে আল্লাহর সেই বিধানের বিরুদ্ধে গিয়ে হত্যাকারীদের ক্ষমা করে বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। আইনের দৃষ্টিতে সাক্ষ্যপ্রমাণে প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী রয়েছে। আমরা যেভাবে ফরজ নামাজ, রোজা পালন করি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিও সেভাবে দেখতে হবে। একাত্তরে যত মানুষ হত্যা করা হয়েছে; তার মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কত ছিল আর মুসলমানই বা কত ছিল? তার মধ্যে মুসলমান ছিল সবচেয়ে বেশি। সেই মুসলমানদের হত্যা করেছে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে বিজয়ী হয়েছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লড়াইয়েও সেভাবে বিজয়ী হতে হবে।

সর্বশেষ খবর