হার্ট ব্লক প্রতিরোধ করার জন্য হার্ট ব্লক সম্পর্কে একটা সঠিক বৈজ্ঞানিক ধারণা থাকা খুবই জরুরি। সচেতন ব্যক্তিরা অবশ্যই জেনে থাকবেন যে, হার্টে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালিগুলির নাম করোনারি আর্টারি। এসব করোনারি আর্টারিরির (নল/টিউব) ভিতর দিকে বিভিন্ন পদার্থ স্তূপাকারে জমা হয়, এসব পদার্থের মধ্যে কোলেস্টেরলের পরিমাণ সর্বাধিক বিরাজমান থাকে, তবে কোলেস্টেরল ছাড়াও অনান্য পদার্থ তাৎপর্যপূর্র্ণ মাত্রায় পাওয়া যায়। বিভিন্ন বস্তু স্তূপাকারে জমা হওয়ার ফলে নলের ভিতরে রক্ত প্রবাহে পথ সংকুচিত হয়ে যায়। নলের মধ্যে স্তূপ হওয়ায় রক্ত প্রবাহের বাধা সৃষ্টি করে বলে এ অবস্থাকে ইংরেজিতে ব্লক বলা হয়। ফলশ্রুতিতে ব্লকে ভাটি অংশে রক্ত সরবরাহ কমে যায় এবং ওই ভাটি অংশের মাংসপেশি পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত না পাওয়ায় রশদ (খাদ্য) ও অক্সিজেনের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে বা অক্সিজেন ও রসদের অভাবে অসুস্থ মাংসপেশির কিছু অংশ নষ্ট (মৃত) হয়ে যায় এবং অন্য অসুস্থ মাংসপেশি কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তাতে হার্ট পর্যাপ্ত পরিমাণ সংকোচন (কাজ) করতে না পারায় বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
চিকিৎসাবিজ্ঞান বহুবিদ গবেষণার মাধ্যমে যা কিছু অদ্যাবধি আবিষ্কার করতে পেরেছে তা-ই হার্ট ব্লকের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এখানে একটি কথা উল্লেখযোগ্য যে, মানুষের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হার্ট ব্লকে প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। কোনো কোনো পরিবারে হার্ট ব্লকের প্রবণতা অন্য পরিবার থেকে বেশি পরিলক্ষিত হয়। তার মানে রক্তের সম্পর্ক আত্মীয়দের মধ্যে প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে, ওপরের কারণ দুটি থাকলে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়, আপনি সচেতনতার মাধ্যমে ও চিকিৎসকের পরামর্শে হার্ট ব্লক হওয়া বন্ধ না করতে পারলেও হার্ট ব্লকেও আক্রান্ত হওয়াকে বিলম্বিত করতে পারে। যার মানে হলো আপনার যদি ৫০ বছর বয়সে হার্ট ব্লকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সে ক্ষেত্রে হয়তো আপনি ৬০ অথবা ৭০ বছর পর্যন্ত বিলম্বিত করতে পারবেন। যেহেতু রক্তনালিতে জমা হওয়া পদার্থের মধ্যে কোলেস্টেরলের আধিক্য পরিলক্ষিত হয় এবং যেসব ব্যক্তির রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বা পরিমাণ বেশি থাকে তাদের মধ্যেও হার্ট ব্লকের প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। যারা হাইপ্রেসারে ভুগছেন, যদি তাদের প্রেসার অনিয়ন্ত্রিত থাকে, তাদের ক্ষেত্রে হাইপ্রেসারের প্রভাবে রক্তনালিতে ইনজুরি সৃষ্টি হয় এবং ইনজুরির ফলে স্থানে স্থানে হার্ট ব্লক সৃষ্টি হয়ে থাকে, যেসব ব্যক্তি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে ভুগছে তাদের ক্ষেত্রে রক্তের সুগারের মাত্রা যত বেশি থাকে, হার্ট ব্লক তত দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে তুলনামূলকভাবে তত অল্প বয়সে হার্ট ব্লকে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়। উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল হার্ট ব্লকের সৃষ্টি ও বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে থাকে। যারা ধূমপান করে অথবা তামাক জাতীয় বস্তু সেবন করেন তাদের বেলায়ও হার্ট ব্লক সৃষ্টি এবং বৃদ্ধি উভয়ই দ্রুত হওয়ায় মানুষ অল্প বয়সেই হার্ট ব্লকে আক্রান্ত হন। কাজের অত্যধিক চাপ, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, একাকিত্বে থাকা ইত্যাদিতে ভোগেন তাদের শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। রক্তে স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা অধিক পরিমাণে বিদ্যমান থাকলে হার্ট ব্লকের মাত্রা বৃদ্ধিও ত্বরান্বিত হয়। যাদের রক্তে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কম থাকে যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় হাইপোথাইরয়েডিজম বলা হয়, তাদের ক্ষেত্রেও অল্প বয়সে হার্ট ব্লকের সমস্যা হতে দেখা যায়। যারা শারীরিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকেন বা কায়িক শ্রম করার সুযোগ পান না, তারা প্রায় সময়ই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে অধিক মাত্রায় কোলেস্টেরলের সমস্যায় অধিক হারে আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং তাদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তিকে শারীরিক ওজন বৃদ্ধি পায়। হার্টের অসুস্থতা হাইপ্রেসার এবং ডায়াবেটিসকে লাইফ স্টাইলজনিত অসুস্থতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হার্ট ব্লক থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে বেশ কিছু পরামর্শ মেনে চলতে হবে। যেমন অতিরিক্ত পশুর চর্বি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, তবে নির্দিষ্ট মাত্রায় বা পরিমাণে চর্বি ছাড়া মাছ, মাংস অবশ্যই খেতে হবে, এতে আপনার শারীরিক যোগ্যতা বজায় থাকবে এবং অনেক ধরনের অসুস্থতা প্রতিরোধে সাহায্য করবে। ধূমপান ও তামাকজাতীয় বস্তু গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। শাক সবজি ও ফলমূলে প্রচুর পরিমাণে এন্টি অক্সিজেন নামক রাসায়নিক থাকে যা হার্ট ব্লক প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। শাকসবজি ও ফলমূলে বিভিন্ন খনিজ লবণ ও পর্যাপ্ত পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন বিদ্যমান থাকায় শারীরিক যোগ্যতা বৃদ্ধি ও অনেক ধরনের অসুস্থতা থেকে মুক্ত রাখে- যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি। পক্ষান্তরে নির্দিষ্ট পরিমাণে শাকসবজি ও ফলমূল বিভিন্ন উপায়ে হার্ট ব্লক প্রতিরোধে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট মাত্রায় কায়িক শ্রম সম্পাদনের ফলে, হাইপ্রেসার, ডায়াবেটিস, ওজন বৃদ্ধি, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা, হরমোনের ভারসাম্য ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে হার্ট ব্লক বৃদ্ধিকে প্রতিহত করতে পারেন যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। যারা তার শারীরিক প্রয়োজনের চেয়ে অধিক মাত্রায় কার্বোহাইড্রেড বা শর্করা বা শ্বেতসারজাতীয় খাবার গ্রহণ করেন, তাদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মাত্রায় শর্করা জাতীয় খাদ্য শরীরে চর্বি হিসেবে মজুত থাকে এবং শারীরিক ওজন বৃদ্ধিসহ আরও অনেক ধরনের অসুস্থতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। হার্ট ব্লক প্রতিরোধে হরমোনাল ভারসাম্য বজায় রাখা, থাইরয়েড হরমোনের সমস্যায় হরমোন থেরাপি চিকিৎসা হার্ট ব্লক নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রেখে ব্লক প্রতিরোধ করে থাকে। হরমোনাল ভারসাম্য রক্ষার্থে সঠিক পরিমাণে ঘুম হওয়া খুবই জরুরি। তাই এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করে সচেতন হতে হবে।
লেখক: চিফ কনসালটেন্ট, শমশের হার্ট কেয়ার, শ্যামলী, ঢাকা।
বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ