হৃদরোগের অনেক প্রকৃতি আছে, তার মধ্যে অন্যতম হার্ট ফেইলিওর বা হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়া। হার্ট ফেইলিউর ক্যান্সারের চেয়েও বেশি প্রাণঘাতী। কেননা ক্যান্সারের রোগীর মৃত্যু ঘটে ধীরে ধীরে, কিন্তু হার্ট ফেইলিউর রোগী মুহূর্তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। অর্থাৎ সময়মতো চিকিৎসা না করলে হার্ট ফেইলিউর রোগের পরিণতি খুব খারাপ। হার্ট ফেইলিওর ক্লিনিক কমাবে মৃত্যুর হার।
আমাদের দেশে হার্ট ফেইলিউরের অন্যতম প্রধান কারণ হার্ট অ্যাটাক। হার্ট অ্যাটাকের ফলে হৃৎপিণ্ডের মাংশপেশি দুর্বল হয়ে যায়। মাংশপেশি দুর্বল হলে হৃদস্পন্দন কমে যায় এবং সেখান থেকেই অজ্ঞতা, চিকিৎসার অপ্রতুলতা ও সময়ক্ষেপণের কারণে হার্ট ফেইলিউরের রোগী মারা যায়।
এ ছাড়াও অনেক কারণ রয়েছে। যেসব রোগীর বাইপাস হয়েছে, হার্টের রিং পরানো হয়েছে, তাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রোগী হার্ট ফেইলিউরের সমস্যা নিয়ে এসেছে। অর্থাৎ হার্ট অ্যাটাকের ফলে তার হৃদযন্ত্র যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল তা পূরণ হয়নি।
দ্বিতীয়ত, হার্ট অ্যাটাক-পরবর্তী সময়ে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তাকে অবহেলা করা।
মানুষ মনে করে বাইপাস হয়েছে, রিং পরানো হয়েছে—চিকিৎসা শেষ, কিন্তু এসবের পরও নিয়মতান্ত্রিক চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। দিন দিন এমন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, কারণ চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে, মৃত্যুর বয়স বাড়ছে।
এই চিকিৎসাটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কারণ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হার্ট ফেইলিউরের রোগীকে ওষুধ খেতে হয়। নিয়মের ভেতর থাকতে হয়।
ইউরোপে হার্ট ফেইলিউরের রোগীর পেছনে বছরে সাড়ে ২৫ হাজার ইউরো ব্যয় হয়। আমাদের দেশে রোগীদের নিজের পকেট থেকে খরচ করতে হয়।
হার্ট ফেইলিউরের চিকিৎসার জন্য কোনো রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে তার মৃত্যুর হার থাকে ৫ শতাংশ। এক বছরের মধ্যে মৃত্যুর হার প্রায় ৩০ শতাংশ, তিন বছরে এই হার ৫০ শতাংশ এবং পাঁচ বছরের ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশ রোগী পাঁচ বছর বেঁচে থাকেন বাকি সবাই মারা যান।
এ রোগটিকে গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে কারণ এটি অন্য সব রোগের মত নয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হার্ট ফেইলরের রোগীর ভোগান্তির শেষ নেই। আবার এ রোগের সঙ্গে আনুষাঙ্গিক রোগ থাকে যেমন: ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ। অধিকাংশ রোগী বয়স্ক হওয়ায় রোগীদের আর্থিক অবস্থাও ভাল থাকে না। যেটা রোগীদের মানসিক অবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। আরেকটি সমস্যা এসব রোগীরা এতই দুর্বল থাকেন যে নিজেরা হাসপাতালে আসতে পারেন না। অসুস্থ অবস্থায় তাদের হাসপাতালে নিতে কালক্ষেপণ হয়, এটি অনেক বড় সমস্যা। তাই যিনি হাসাপাতালে নিয়ে আসেন তাদের এ ধরণের রোগীর প্রতি সহমর্মী হতে হবে।
একটি বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে এ রোগীদের চিকিৎসা করা হয়, বিশ্বজুড়ে এ পদ্ধতিকে বলে ‘হার্ট ফেইলর ট্রেনিং’। আমাদের দেশেও এটি পুরোন পদ্ধতি। রোগীর চিকিৎসা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ রাখতে হবে। রোগীর জন্য একজন নার্স, প্যারামেডিকস, ডায়বেটলজিস্ট, কিডনী স্পেশালিস্ট থাকতে হবে। সব কিছু মিলিয়ে একটি গ্রুপ থাকবে যারা রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করবে।
আমাদের এখানে যখন রোগী আসে আমরা রোগীর অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা দেই। রোগীদের সঙ্গে নিয়মিত নিবিড় যোগাযোগ রাখলে এ চিকিৎসা অনেকটাই সহজ হয়। আমাদের সফটওয়্যার নির্দেশনা দেয় রোগীকে কতদিন পরপর ফলোআপ করতে হবে। আমাদের নার্স সকালে এসে কম্পিউটার খোলার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পারে কোন কোন রোগীকে আজ ফোন দিতে হবে। এরপর ওই রোগীর যাবতীয় তথ্য নেয়া হয়, যেমন : নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছেন কিনা, ওজন কত হল ইত্যাদি। নার্স এসব তথ্য নিয়ে আমাদের সঙ্গে পরামর্শ শেষে রোগীকে একটি নতুন প্রেসক্রিপশন পাঠান। এরপর আবার তিন থেকে পাঁচ দিন পর রোগীর অবস্থা কেমন, তিনি কেমন বোধ করছেন এসব তথ্য জানতে যোগাযোগ করা হয়। এটি রোগীকে মানসিকভাবে সাহায্য করে। এছাড়া ছোটখাট কোন সমস্যা হলে এর চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেই। ফলে রোগীদের আবারও হাসপাতালে আসার পর্যায়ে যেতে হয় না। এভাবে প্রায় ১ হাজার ৪০০ রোগীকে সেবা দিয়ে থাকি।
বিদেশে এসব কাজ নার্সরাই করে থাকেন। ওদের সিস্টেম আরও স্বয়ংক্রিয়। ফলে বিশেষজ্ঞ কর্তৃত রোগ নির্ণয় ও প্রেসক্রিপশন নির্ধারণের পর রোগীর নিয়মিত চিকিৎসায় নার্সই যথেষ্ট। আমাদেরও চিকিৎসা ব্যবস্থা ও ওষুধের উন্নতি হয়েছে। সময়মত এবং নিয়মিত চিকিৎসা নিলে হার্ট ফেইলরের রোগী ভাল হয়ে ওঠবেন। অন্তত ভোগান্তিটা কমে যাবে। প্রান্তিক পর্যায়ে যেসব রোগী রয়েছেন তাদের এ পদ্ধতি ভাল চিকিৎসা দেয়া সম্ভব।
হার্ট ফেইলরের লক্ষণগুলো বুঝতে পারাটা গুরুত্বপূর্ণ। এই রোগের উপসর্গ দেখা গেলে অনেকেই ভাবে অ্যাজমা হয়েছে। যাদের আগে হার্টের অসুখ ছিল তারা যদি অল্পতেই হাপিয়ে যান, হাত-পায় পানি জমে, রাতে ঘুমানোর সময় দম বন্ধ হয়ে যায় তবে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। এগুলো সবই হার্ট ফেইলরের লক্ষণ। আগে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, রিং পড়ানো হয়েছে তাদের এমন হলে দু্রত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।
হার্ট ফেইলরের রোগীর পানি পানের বিষয়টি আমরা সীমিত করি। ডাব-স্যালাইন ইত্যাদি খাওয়া বন্ধ করতে হবে। কাঁচা লবণ খাওয়া বন্ধ করতে হবে। লবণ খাওয়ার জন্য এ সমস্ত রোগীদের শরীর নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এগুলো এড়িয়ে যেতে হবে। সচেতন থাকতে হবে।
লেখক: চিফ কনসালটেন্ট, ইউনাইটেড হাসপাতাল