সোমবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিষণ্নতার ব্যবচ্ছেদ

বিষণ্নতার ব্যবচ্ছেদ

মানসিক রোগ যে অন্যতম একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা, সেটি দেরিতে হলেও আমরা তথা তৃতীয় বিশ্বের মানুষ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছি। পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৪৫ কোটি মানুষ মানসিক রোগের শিকার, আর শুধু এককভাবে ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতার শিকার প্রায় ৩৫ কোটি। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশে প্রায় ১৬.৫ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক ও ১৮.৪ শতাংশ শিশু-কিশোর ডিপ্রেশনে ভুগে থাকেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী (২০০৫) শতকরা ৪.৬ ভাগ নারী-পুরুষের বিষণ্নতা রয়েছে। ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে সাধারণত যেসব উপসর্গ দেখা যায়, তার মধ্যে মন-মেজাজ ভালো না লাগা, প্রায় সব বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, উদ্যোগ, উদ্যম কমে যাওয়া, এক ধরনের অবসাদ চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে সব সময়। এছাড়া মনোযোগের অভাব, মনের ভিতর এক ধরনের অস্থিরতা, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, নিজেকে সব কাজের জন্য অযোগ্য মনে করা, অকারণে বা সামান্য কারণে কান্না পাওয়া, নিজেকে অপরাধী মনে করা, নিজের বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার ফলে চরম হতাশ অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয় এবং অনেকে আত্মহত্যা করে জীবন শেষ করে থাকেন। এছাড়াও কিছু কিছু জৈবিক সমস্যা ডিপ্রেশনকে আরও জটিল করে তোলে, যেমন- অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, যৌন আকাঙ্ক্ষা মারাত্মকভাবে কমে যাওয়া, দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক কাজকর্মে অক্ষমতা, পারস্পরিক সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি। এসব উপসর্গ যখন দুই সপ্তাহের বেশি সময় স্থায়ী হয়, তখনি ব্যক্তি বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। সাধারণত ১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সের যে কেউ বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতে পারেন, তবে ২৪-৩৫ বছরের মধ্যে এ রোগের সম্ভাবনা বেশি। বয়স্ক ব্যক্তি ও মহিলাদের মধ্যে ডিপ্রেশনের হার অনেক বেশি। শিশু-কিশোররাও এ রোগের হাত থেকে মুক্ত নয়।

ডিপ্রেশনের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম- জৈব রাসায়নিক, সামাজিক, মানসিক ইত্যাদি। এ সময় মস্তিষ্কের কিছু জৈব রাসায়নিক পদার্থের যেমন- সেরোটনিন, নর-অ্যাডরেনালিন ইত্যাদি জৈব রাসায়নিক পদার্থগুলোর পরিমাণগত ও গুণগত তারতম্য ঘটে থাকে। সামাজিকভাবে নিজেকে গুটিয়ে ফেলা, একাকিত্ব, দারিদ্র্য, শোক ইত্যাদিও সামাজিক কারণ হতে পারে। মানসিক কারণগুলোর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব, অন্যের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার অনীহা, অক্ষমতা, শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদি। এ ধরনের সামাজিক কারণগুলো বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়। এ ছাড়াও বংশগতির ঝুঁকি তো রয়েছেই।

বিষণ্নতা রোগ শনাক্তকরণ, চিকিৎসা ও চিকিৎসাপরবর্তী ফলোআপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আবার কখনো অজ্ঞতার কারণে মারাত্মক বিষণ্নতাকে উপেক্ষা করে থাকি। সারা বিশ্বে ৪৫ কোটি মানুষ, নানারকম মানসিক রোগে আক্রান্ত। ৩৫ কোটি মানুষ শুধু ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। আমাদের দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত। এ বিপুলসংখ্যক মানসিক রোগীর চিকিৎসা, অক্ষমতা, অকর্মণ্যতা ইত্যাদি কারণে পরিবার, সমাজ তথা জাতীয় পর্যায়ে যে আর্থিক ও কর্মঘণ্টার ক্ষতি হচ্ছে তা হিসাব করলে দেখা যায়, রোগ সংক্রান্ত বৈশ্বিক বোঝা বা অক্ষমতার প্রায় ১৩ শতাংশই মানসিক রোগের কারণে হয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ডিপ্রেশন বর্তমানে রোগজনিত অক্ষমতার অন্যতম চতুর্থ কারণ এবং ২০৩০ সালে ডিপ্রেশনই হবে অক্ষমতার প্রধান কারণ। ডিপ্রেশন শুধু এককভাবে রোগজনিত অক্ষমতা তৈরি করে না। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, প্রধান প্রধান শারীরিক অসুখ যেমন- ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, ক্যান্সার, শ্বাসজনিত রোগ, হার্টের অসুখ, কিডনি রোগ ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই বিষণ্নতা এসব রোগের চিকিৎসা ও উপসমকে দীর্ঘায়ু করে তোলে।

অধ্যাপক ডা. মো. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী

সাবেক পরিচালক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

ও হাসপাতাল, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর