বৃহস্পতিবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

সব মোটা গরুই সুস্থ নয়!

সব মোটা গরুই সুস্থ নয়!

গবেষকরা বলছেন, হরমোন প্রয়োগে মোটা-তাজা করা পশুর মাংস খেলে মানুষের ব্রেস্ট, কোলন, প্রোস্টেট এবং ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার আশংকা রয়েছে। এসব বিষয় জানতে ডা. সজল আশফাকের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত লিখেছেন —শামছুল হক রাসেল

কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে আমাদের দেশের খামারিরা গরু মোটাতাজাকরণের পরিকল্পনা নেয়। যদিও গরু মোটাতাজাকরণের জন্য স্বীকৃত স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি রয়েছে কিন্তু গরুকে দ্রুত মোটা ওজনদার করার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই খামারিরা (কোনো কোনো খামারি) অনৈতিকভাবে স্টেরয়েডসহ বেশ কিছু হরমোন প্রয়োগ করে থাকেন। তাদের মতে বেশি ওজন মানেই বেশি মাংস; বেশি মাংস মানেই বেশি লাভ। গবেষকরা বলছেন, হরমোন প্রয়োগে মোটা-তাজা করা এইসব পশুর মাংস খেলে মানুষের ব্রেস্ট, কোলন, প্রোস্টেট এবং ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গরু মোটাতাজাকরণ একটি নিয়মিত ও প্রচলিত পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত দুই থেকে আড়াই কেজি ইউরিয়া, লালিগুড় ও খড়ের একটি বিশেষ ধরনের মিকশ্চার খাওয়ানোর পরামর্শ  দিয়ে থাকে সরকারের প্রাণিসমপদ বিভাগ। টানা ৮ দিন কোনো পাত্রে এই মিকশ্চার মুখবন্ধ অবস্থায় রাখার পর, তা রোদে শুকিয়ে গরুকে খাওয়াতে হয়। একটানা ৬ মাস এটা খাওয়ালে গরু খুব দ্রুত মোটাতাজা হয়ে ওঠে। কিন্তু আরও দ্রুত এবং আরও বেশি মোটা করার আশায় খামারিরা প্রয়োগ করে থাকে স্টেরয়েডসহ আরো কিছু হরমোন এবং মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া।

বাড়তি ইউরিয়ায় গরুর বিষক্রিয়া: কোরবানিতে দ্রুত মোটাতাজাকরণের উদ্দেশে গরুগুলোকে খেতে দেয় অতিরিক্ত ইউরিয়া। কোনো গরুকে কয়েক মাস ধরে ইউরিয়া খাওয়ালে গরু দ্রুত দানব আকৃতি ধারণ করে। কিন্তু ইতোমধ্যে গরুর শরীরের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিডনি, লিভার, ব্রেইন নষ্ট হয়ে গরুর মৃত্যুকে অনিবার্য করে তোলে। অতিরিক্ত ইউরিয়া বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ফলে এগুলো প্রাকৃতিকভাবে বেঁচে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলে। অনেক সময় হাটেই এসব গরু মারা যায়। এই ধরণের গরুকে বিষাক্ত গরু বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ইউরিয়া বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত গরুর মাংস খেলে মানুষও ইউরিয়া বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। যার ফলে মূলত কিডনি বিকল হওয়ার মতো ঝুঁকিও থাকে। গরুকে মোটাতাজাকরণে ইতিহাস খুঁজলে অনেক আগে থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃত্রিমভাবে তৈরি হরমোন প্রয়োগ করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গরম্নর মাংসপেশিতে হরমোন ইনজেকশন দেয়া হয় কিংবা কানের চামড়ার নিচে পুঁতে দেয়া হয়। কানের চামড়ার নিচে পুঁতে দেয়া এই হরমোন ধীরে ধীরে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় শরীরে প্রবেশ করে থাকে। কৃত্রিমভাবে তৈরি ইস্ট্রোজেন এবং টেস্টোস্টেরন ইনজেকশনই একসময় বেশি প্রয়োগ করা হতো। সত্তর দশকের দিকে এই হরমোনের একটি উপাদান ডাইইথাইলস্টিলবেস্টেরলের সঙ্গে যোনীপথের ক্যান্সার সৃষ্টির যোগসূত্র ধরা পড়লে তা নিষিদ্ধ করা হয়। এদিকে ইস্ট্রোজেনের সঙ্গে স্তন ক্যান্সারের সম্পর্ক থাকার বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার পর এই হরমোনটির প্রয়োগও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। আরও বেশি নিরাপদ হরমোন খুঁজতে গিয়ে তৈরি হয় বোভাইন সোমাটোট্রপিন (বিএসটি) অথবা রিকম্বিনেন্ট বোভাইন গ্রোথ হরমোন (আরবিজিএইচ)। ১৯৯৩ সালে আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) গরুর দুধ ও গরুর দৈহিক বৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য কৃত্রিমভাবে তৈরি এই হরমোনের প্রয়োগকে অনুমোদন দিলেও, ইরোপিয়ান ইউনিয়ন, কানাডাসহ বেশ কিছু দেশ তা অনুমোদন দেয়নি। সাম্প্রতিককালে সারা বিশ্বেই খাবার হিসেবে গ্রহণযোগ্য প্রাণীতে হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগের বিষয়টি নিয়ে ভোক্তারা সোচ্চার ও সচেতন ভূমিকা রাখছেন। অভিভাবকরা মনে করছেন হরমোনযুক্ত মাংস গ্রহণের কারণেই শিশুদের বিশেষ করে কন্যাশিশুদের মধ্যে আগাম যৌবনপ্রাপ্তি ঘটছে। কিন্তু হরমোন প্রয়োগ করার পর কিছুটা হরমোন যে পশুর মাংসে উচ্ছিষ্ট হিসাবে রয়ে যায়, এই বিষয়ে গবেষকদের মধ্যে কোন মতভেদ না থাকলেও, উচ্ছিষ্ট হরমোনের কার্যকারিতা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞই। খামারীদের পক্ষ অবলম্বনকারী গবেষকদের কথা হচ্ছে, গরুর দুধ ও মাংসে উচ্ছিষ্ট এই হরমোনের মাত্রা এতটাই কম যে, তা ভোক্তার দেহে কোনো ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না। আবার একইপক্ষের আরেকদল গবেষক বলছেন, উচ্ছিষ্ট অবস্থায় বিদ্যমান বোভাইন সোমাটোট্রপিন (বিএসটি) প্রকৃতপক্ষে একটি মৃত হরমোন, এর কোন কার্যকারিতা থাকার কথা নয়। কিন্তু হরমোন নিয়ে এই বির্তক এখনো চলমান। বেশ কিছু গবেষণায়, গরুর মাংসের উচ্ছিষ্ট হরমোন এর সাথে মানুষের ব্রেস্ট, কোলন, প্রোস্টেট এবং ফুসফুসের ক্যান্সার সৃষ্টির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। ওরাডেকসন ও ডেকাসনের মতো স্টেরয়েড দিলে ২-৩ মাসের মধ্যেই গরুগুলো বিশাল আকৃতি ধারণ করে। গরুর শরীরে পানি জমতে থাকে। গরু ফুলে ফেঁপে বিশাল অস্বাভাবিক বেঢপ আকৃতির দানবে পরিণত হয়। প্রাণিবিদরা বলছেন, এ ধরনের গরু দেখলেই চেনা যায়। প্রাকৃতিকভাবে শক্তি সামর্থের কোন গরু যেমন তেজি ও গোয়ার প্রকৃতির হয়, এই গরুগুলো ঠিক উল্টোভাব, ধীর ও শান্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর