আগামী ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হয় এ দিনটি। ১৯৯২ সাল থেকে ১৫০টি দেশের সমন্বয়ে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথের উদ্যোগে পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ১০ অক্টোবর পালিত হবে এ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য-‘কর্মস্থলে মানসিক স্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার।’ মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য অনেক বিষয়ের মধ্যে কর্মস্থল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গবেষণায় দেখা যায়, ৬০% লোক কোনো না কোনোভাবে কর্মস্থলে ঝুঁকির মধ্যে থাকে। কর্মস্থলে নিয়মিত মিটিং করা, ভালো যোগাযোগ করা, কর্মীদের উৎসাহ দেওয়া, পজিটিভ কথা বলা, তাদের সুখ-দুঃখের কথাগুলো শোনা খুবই জরুরি। অন্যদিকে পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে ছেলের হাতে পিতা খুন, পরকীয়ার কারণে সন্তানের মৃত্যু, কর্মীদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, ড্রাইভারদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় খুন ইত্যাদি নানা খবর। গত ২০০৩-২০০৫ সালে WHO-এর সহযোগিতায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট কর্তৃক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৬ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগে আক্রান্ত। এই হিসাব মতে, ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে দুই কোটির বেশি মানসিক রোগী। এর মধ্যে বেশির ভাগ হচ্ছে টেনশন ঘটিত রোগ যা অ্যাংজাইটি গ্রুপের রোগ হিসেবে চিহ্নিত। এই বিশাল অংশের রোগী এই ডাক্তার ওই ডাক্তার থেকে শুরু করে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও অন্যান্য প্রাইভেট সেন্টারে এই রোগের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু বাধাগুলো হলো সামাজিক কুসংস্কার, অজ্ঞতা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ওষুধের প্রয়োজনীয়তা। এ ছাড়া রোগীদের চিকিৎসা নিতে অপারগতা রয়েছেই। অনেকেই মনে করেন, মানসিক হাসপাতাল ও ডাক্তারের কাছে গেলে কেউ দেখে ফেলল কি না? আমি কি পাগল হয়ে গেছি নাকি আমাকে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে কেন? আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অনেক শঙ্কা, দ্বিধাদ্বন্দ্ব এমনকি অস্বীকার করার প্রবণতা যে তাদের পরিবারে একজন মানসিক রোগী আছে। চিকিৎসার প্রতি অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা। মৃগী রোগীর লেখাপড়া, বিয়ে, সংসার নিয়ে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজে, স্কুলে ও পাড়ায় সর্বত্র কুসংস্কার যে, এদের পড়াশোনা হবে না, বিয়ে হবে না বাচ্চা হবে না ও সংসার করতে পারবে না। গ্রামেগঞ্জে ও শহরে সর্বত্র অজস্র ফকির, কবিরাজ, তাবিজ-কবজওয়ালাদের দৌরাত্ম্য ইত্যাদি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে- বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা ৫১০ জন রোগীর মধ্যে গবেষণায় দেখা গেছে, টেনশন, ভয় পাওয়া, মাথাব্যথা ও বিভিন্ন পারিবারিক সমস্যা রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মাথাব্যথা যে পারিবারিক ও সামাজিক চাপ থেকে হয় তা রোগীরা বুঝছে ও রোগীদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে। গত বছর শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে যে, ১৭% শিশু মানসিক রোগীর মধ্যে মৃগী রোগ, শিশুদের আচরণের সমস্যা, মানসিক প্রতিবন্ধী ও বিষণ্নতা অন্যতম। তাই ওপরের বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে, মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা কত ভয়াবহ। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে- ১ সামাজিক কুসংস্কারমুক্ত করা ২. সচেতনতা বৃদ্ধি করা ৩. মানসিক চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা ৪. প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া ৫. সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত রোগীদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা ভাবা ৭. সরকারিভাবে রিহ্যাব সেন্টারের ব্যবস্থা করা যেতে পাড়ে। শিক্ষক, যুবক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা। তাই এ বিষয়ে অবহেলা না করে যথেষ্ট সচেতন ও যত্নবান হতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শেরে বাংলা নগর, ঢাকা।