রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের কোনো তুলনা উপমহাদেশে নেই

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের কোনো তুলনা উপমহাদেশে নেই

রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধা, ১৯৭১ আলোকচিত্র : রঘু রায়

আজ ২৬ মার্চ। আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ৪৭ বছর আগে এই দিনে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে এই স্বাধীনতা আক্রান্ত হয় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের কোলাবরেটর রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি নৃশংস ঘাতক বাহিনী দ্বারা। আক্রান্ত স্বাধীনতাকে রক্ষা ও স্থায়িত্বদানের জন্য লাখ লাখ মানুষকে আত্মদান করতে হয়েছে; অসংখ্য মা-বোনকে সম্ভ্রম খোয়াতে হয়েছে, প্রাণ দিতে হয়েছে। দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের রক্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে।

মনে হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধা রাজপুত্ররা রক্তের অতল সমুদ্রে ডুব দিয়ে ঝিনুকের কৌটায় রক্ষিত হানাদার রাক্ষসের প্রাণভোমরা হত্যা করে স্বাধীনতা নামক রূপসী রাজকন্যাকে মুক্ত করেছে এবং সেই রাজকন্যা তার রূপের আভায় দেশটিকে আবার আলোকিত করে তুলেছে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ— এই তিনটি রক্ষাকবচ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল আমাদের এই স্বাধীনতার গলায় কণ্ঠহার হিসেবে। এটা ৪৭ বছর আগের কথা। ‘এক হাতে মোরা বাঘেরে রুখেছি, আর হাতে মোগলেরে’— কবির এই বাণী গত শতকের সত্তর দশকে বাংলাদেশের জন্য সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হানাদারদের কারাগার থেকে দেশে ফিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো মানুষের সমাবেশে বলেছিলেন, ‘কবিগুরু আপনি বলেছিলেন, সাত কোটি বাঙালির হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি। এ কথা আজ আর বাঙালির বেলায় সত্য নয়, আপনি এসে দেখে যান, বাঙালি আজ জেগেছে। তারা আর ভেতো বাঙালি নয়, তারা অস্ত্র ধরতে শিখেছে, তারা নিজেদের স্বাধীন করেছে।’

এটা ৪৭ বছর আগের সত্য। কিন্তু স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের হত্যা করে এই সত্যের ব্যত্যয় ঘটানো হয়। পঁচাত্তরের জাতীয় ট্র্যাজেডির পর থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটি আক্রান্ত স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার প্রধান রক্ষাকবচ ছিল মূলত তিনটি মূলমন্ত্র— গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তা। তার দুটিকে স্বাধীনতার কণ্ঠ (সংবিধান) থেকে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। এ দুটি হলো সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।

ভারতের সুভাষবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক পার্টির এক নেতা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পর বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের কোনো তুলনা উপমহাদেশে নেই। ভারত ও পাকিস্তান দুটি দেশই স্বাধীন হয়েছে আপস-আলোচনার মাধ্যমে। ব্রিটিশ কলোনিয়াল শাসনের এবং সেই আমলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির লেগাসি এই দুটি দেশ এখনো বহন করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। অসাম্প্রদায়িক জনযুদ্ধের মাধ্যমে।’

ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা আরও বলেছিলেন, ‘উপমহাদেশে শেখ মুজিবের নেতৃত্বের বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি শুধু এক ফ্রন্টে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেননি, অন্য ফ্রন্টে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও লড়াই করেছেন এবং এই অসুরটিকে রণক্ষেত্রে বধ করেছেন। তিনি শুধু গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে চাননি; চেয়েছেন একটি সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের দেশ গড়ে তুলতে। রক্তমূল্যে অর্জিত এই স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের খুঁটির জোর এত বেশি যে সহসা তা আক্রান্ত ও বিপন্ন হতে পারে না।’

এই ব্যক্ত আশাবাদ সাড়ে তিন বছর পর মনে হয়েছে ব্যর্থ হতে চলেছে। পাকিস্তানে গণতন্ত্র উচ্ছেদ করে সেনাতন্ত্র ও মোল্লাতন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত শাসক ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রতিভাস সৃষ্টি হতে থাকে বাংলাদেশেও। পাকিস্তানের এক বিখ্যাত সাবেক কূটনীতিকের ভাষায়, The alliance between Mosque and Military in Pakistan created a dangerous situation in the subcontinent. (পাকিস্তানে সেনাবাহিনী ও মৌলবাদীদের মধ্যে সমন্বয় গোটা উপমহাদেশের জন্যই এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে)।

ভারতও এই দ্রুত পরিবর্তিত পরিস্থিতির ধাক্কা থেকে রক্ষা পায়নি। বাংলাদেশের শেখ মুজিবের মতো ভারতের ইন্দিরা গান্ধীকেও হত্যা করা হয়। তার পর থেকে ভারতেও শুরু হয় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক কালচারের পশ্চাদপসরণ। ভারতীয় বামপন্থিদের অতি বড় বামপন্থি-বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তির দরুন তাদের বিভক্তি ও অনৈক্য এবং কংগ্রেস শিবিরে নৈরাজ্য এই গণতান্ত্রিক দেশটিতে হিন্দুত্ববাদের অভ্যুদয় অনিবার্য করে তোলে, যার ফলে হিন্দু মহাসভার উত্তরসূরি সাম্প্রদায়িক বিজেপির পক্ষে দিল্লির মসনদে বসাও সম্ভব হয়েছিল এবং ভবিষ্যতেও সম্ভব হতে পারে। বর্তমানে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে এসেছে বটে, কিন্তু তার অতীতের সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা হঠানোর নীতিতে অটল থাকতে পারেনি। তাদের মধ্যেও বিজেপি-অনুসৃত নীতি ও হিন্দুত্ববাদের পরোক্ষ অনুসরণ লক্ষ করা যাচ্ছে।

অনেক ইতিহাসবিদই মনে করেন, নবাব সিরাজদ্দৌলাকে হত্যা করে বাংলাদেশ দখল করা না গেলে ইংরেজদের পক্ষে পরবর্তীকালে দিল্লি দখল করে ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতো না; তেমনি বাংলাদেশে শেখ মুজিবকে হত্যা করে একটি সেক্যুলার ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্রের ভিত্তিটাকে ভেঙে দিতে না পারলে পরবর্তীকালে উপমহাদেশে ইন্দিরা হত্যা, ভুট্টো হত্যা, জঙ্গি ইসলাম ও হিন্দুত্ববাদের অভ্যুদয় সহজ হতো না।

জঙ্গি ইসলাম ও হিন্দুত্ববাদের অভ্যুদয়ে সাহায্যদানে এবং সেক্যুলারিজম ও গণতন্ত্রের ভিত্তিতে রাষ্ট্র নির্মাণের বিরোধিতায় বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের নেতা আমেরিকাও বড় ভূমিকা নিয়েছে। আফগান তালেবানদের সৃষ্টি আমেরিকা ও সৌদি আরবের যৌথ প্রচেষ্টায়। লক্ষ্য ছিল কমিউনিজমের জোয়ার ঠেকিয়ে মার্কিন আধিপত্য রক্ষা। উপমহাদেশেও গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর পতন ঘটানো এবং ধর্মীয় মৌলবাদীদের তোল্লা দেওয়ার কাজে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। এখন নিজেদের সৃষ্ট দানবের বিরুদ্ধেই তারা লড়ছে।

বাংলাদেশও দক্ষিণ এশিয়ায় একটি ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে যাচ্ছে— এই আশঙ্কায় একাত্তরের পরাজিত সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তি এবং পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ব্রেন ওয়াশিং থেকে তখনো মুক্তি পায়নি। সেই বাংলাদেশ আর্মির এক অংশ আঁতাত গড়ে তোলে। পেছনে অর্থ ও মন্ত্রণাদাতা আমেরিকা ও তাদের বশংবদ সৌদি রাজতন্ত্র। চীনও তখন তাদের ভারতবিরোধী নীতির স্বার্থে এই অপশক্তিকে পরোক্ষভাবে মদদ জুগিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সেই স্বাধীনতার ভিত্তিগুলো ধ্বংস করার চক্রান্ত পঁচাত্তর-পূর্ব থেকেই শুরু এবং ১৫ আগস্টের জাতীয় ট্র্যাজেডি এই চক্রান্তেরই পরিণতি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা তখন থেকে আক্রান্ত এবং তার গণতন্ত্র রাক্ষসপুরীতে বন্দী ঘুমন্ত রাজকন্যার মতো। অতীতে অনেক স্বাধীনতা দিবসেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা তার নামে দিবস পালনের প্রহসন দেখেছে; সেই সঙ্গে দেখেছে তার আক্রান্ত শরীরে অনবরত রক্তক্ষরণ। আমাদের স্বাধীনতা যদি না টেকে তাহলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় টিকে থাকাও অর্থহীন; তাকে যতই লাইফ সাপোর্ট মেশিনে রাখা হোক না কেন। তাই ৪২ বছর আগে ভারতের ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, তা সঠিক হয়নি। সাফল্যজনকভাবে তার ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে বলেই আমরা অনেকে ধরে নিয়েছিলাম।

আমাদের এই ধারণা করার একটা কারণও ছিল। ‘মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি’ বাংলাদেশেও ক্ষমতা দখলের পর যেভাবে বছরের পর বছর স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করেছে, মুক্তিযুদ্ধের আসল নায়কদের একদিকে চরিত্র হনন এবং অন্যদিকে খলনায়কদের তাদের স্থলাভিষিক্ত করার অবিরাম চেষ্টা চালিয়েছে, তাতে স্বাধীনতা-পরবর্তী একটি বা দুটি প্রজন্মের এমনভাবে মস্তিষ্ক ধোলাই হয়েছে যে এই বিভ্রান্তির কুয়াশামুক্ত হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না বলেই মনে হয়েছিল। এই কুয়াশামুক্তির জন্য ভবিষ্যতের আরও দু-এক প্রজন্ম আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, এমন ধারণাও অনেকের মনে জন্মেছিল।

সন্দেহ নেই বাংলাদেশের আক্রান্ত স্বাধীনতা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রাক্ষসপুরীর ঘুমন্ত রাজকন্যার মতো বাংলাদেশের গণতন্ত্রেরও নিদ্রা ভেঙে জেগে ওঠার আভাস দেখা যাচ্ছে। ফলে শত্রুপক্ষও আবার নতুন করে সংঘবদ্ধ হয়েছে। তাদের হাতিয়ার ধর্মান্ধতার পুরনো ভোঁতা অস্ত্র ও মিথ্যা প্রচার। এবারের স্বাধীনতা দিবসের বৈশিষ্ট্য, লড়াকু তরুণ প্রজন্ম স্বাধীনতাকে আর আক্রান্ত দেখতে চায় না। তাদের লড়াইয়ে স্বাধীনতা আক্রমণমুক্ত হলে গণতন্ত্রও বিপদমুক্ত হবে।

 

লেখক : ভাষাসংগ্রামী ও প্রবাসী সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর