রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

স্বাধীনতা

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

স্বাধীনতা

ক্যালেন্ডারের মার্চ মাসটা শুধু উপমহাদেশই নয়, গোটা বিশ্বের কাছেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ মাসেই বাঙালিদের জন্য একটা আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এ মাসেরই সাত তারিখে নতুন রাষ্ট্রের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার এক বিশাল জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার  চূড়ান্ত লড়াইয়ের কথা। তিনি বলেছিলেন, তার সংগ্রাম পাকিস্তানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। এই সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, এখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো পথ নেই। কার্যত তার এ বক্তৃতার পরেই পাকিস্তানি সৈন্যরা এবং তাদের দালালচক্র, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসরা বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে জেলা সদর দফতরগুলোয় স্বাধীনতাবিরোধীরা একই সঙ্গে আওয়াজ তোলে— পাকিস্তান জিন্দাবাদ। আর বঙ্গবন্ধুর আওয়াজ ছিল জয় বাংলা।

এই মার্চের ১৭ তারিখে ফরিদপুর জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নিয়েছিলেন এ বীর যোদ্ধা। তিনি সেদিনের জনসংখ্যার নিরিখে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে একই ছাতার তলায় এনেছিলেন। এখানে জাত-ধর্ম কিছু ছিল না। সবার মুখে ছিল জয় বাংলা ধ্বনি। কেন তিনি পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, তার লম্বা ইতিহাস। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি তিল তিল করে আওয়ামী লীগ দলকে শক্তিশালী করে তোলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তার এই সংগ্রাম দাবিয়ে রাখা যাবে না। পাকিস্তান দাবিয়ে রাখার জন্য সাধারণ মানুষের ওপর চরমতম অত্যাচার শুরু করে দেয়। ভয়ে সন্ত্রস্ত এক কোটিরও বেশি মানুষ পালিয়ে আসেন ভারতের এপার বাংলার পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা আসামে। তাদের পিছু ধাওয়া করে রাস্তায় ফেলে পাকিস্তানি সৈন্যরা পদ্মা-মেঘনার জল লালে লাল করে দেয়। আর আমরা এপারে বসে দেখেছি সেই লাশের স্তূপ। বঙ্গবন্ধু ও তার দল নির্বাচনে পাকিস্তান সংসদে ১৬৯টি আসন পায়। স্বভাবতই গণতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী তিনি সরকার গড়তে চান। কিন্তু পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং তার পরামর্শদাতা পাকিস্তান পিপলস পার্টির জুলফিকার আলি ভুট্টো ইসলামাবাদ থেকে ঢাকায় ছুটে আসেন। তারা মুজিব এবং তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনা চালান। আর একই সঙ্গে চালায় নিপীড়ন-খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধ। বঙ্গবন্ধু তখন ঠিক করলেন আর নয়। ৭ থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত হাজার হাজার লোক ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চলে আসেন। বঙ্গবন্ধু তখন স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য প্রস্তুত। ঘোষণাও লিখে ফেলেছেন। এর মধ্যে ২৫-২৬ মধ্যরাতে তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। তার নির্দেশ অনুযায়ী গ্রেফতারের সংবাদ প্রচার হওয়া মাত্রই ৪৬ বছর আগে এই দিনেই মুক্তিবাহিনীর দখল করা রেডিও স্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হয়।

তখন পাকিস্তানিরা জোর করে বাঙালিদের হাত থেকে বাংলাদেশ কেড়ে নেওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে থাকে। এ যুদ্ধে শামিল হয় বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ। তারা পশ্চিমবঙ্গে চলে এসে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকার আল-বদর, আল-শামসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দেয়।  সেদিন এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারতের সব সম্প্রদায়ের মানুষ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

কোটি লোকের মধ্যে যারা এপার বাংলায় এসেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। তারা কলকাতায় বসে গণপরিষদ ডেকে একটি খসড়া সংবিধান তৈরি করে ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করেন এবং শপথ নেন। শপথ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা দিল্লির কাছে এ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। ইতিমধ্যে পাকিস্তান ভারত ভূখণ্ডে আইএসআই এবং রাজাকারদের পাঠিয়ে দেয় শরণার্থীদের সঙ্গে। তারা বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে বিদ্বেষ ছড়াতে শুরু করে। ভারতের গোয়েন্দারা এদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়। ৪৬ বছর আগেরকার ঘটনা আমার স্পষ্ট মনে আছে। মেহেরপুরে শপথ নেওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাকে রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। অপর তিন মন্ত্রী হলেন কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং খন্দকার মোশতাক আহমদ। শপথ নেওয়ার পরই সাংবাদিকদের তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, আমরা চাই ভারত সরকারের স্বীকৃতি। কড়া নিরাপত্তায় বেষ্টিত ওই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত (আমার সোনার বাংলা...) গান আরেক নেতা অধ্যাপক ইউসুফ আলী। বিএসএফএর দেওয়া একটা ভাঙা হারমোনিয়াম বাজিয়ে তিনি যখন গাইছিলেন, তখন বাঙালি সাংবাদিকরা উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। আর বিদেশি সাংবাদিকরা বুঝতে পারেননি। তখন ভারতীয় সাংবাদিকরাই তাদের বলেন, স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীত হচ্ছে। তোমরা উঠে দাঁড়াও।

যুদ্ধ যে আগেই শুরু হয়েছিল তা উল্লেখ করেছি। পাকিস্তানের অত্যাচার ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট থেকেই শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ অনেক ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। তাই ৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ঢাকার বিখ্যাত দৈনিক ইত্তেফাক কাগজের সম্পাদক সম্পাদকীয় লিখে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার শিরোনাম ছিল— ‘বাঙালি রুখিয়া দাঁড়াও’।

’৪৭-এ যা শুরু হয়েছিল, ৬৫-এর যুদ্ধে বাংলাদেশের সব বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করা গিয়েছিল। সেখানে কোনো জাত বা ধর্মের বিভেদ ছিল না। পাকিস্তান একতরফাভাবে ৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতকে আক্রমণ করে। ভারত যৌথবাহিনী গঠন করে পাকিস্তানকে জবাব দিয়েছিল। এই ৯ মাস অস্থিরতা আর ১৩ দিনের যুদ্ধে পাকিস্তান পর্যুদস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। সেই ইন্দিরা গান্ধী ১৬ ডিসেম্বর যখন ভারতের জয়ের কথা ভারতের সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন তখন সংসদে উপস্থিত ৫৪৫ জন সদস্য বিপুল হর্ষধ্বনি করে তাকে অভিনন্দন জানালেন। জনসঙ্ঘের নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি দেবী দুর্গার সঙ্গে তাকে তুলনা করেছিলেন। নেতা ত্রিদিব চৌধুরী বলেছিলেন, আমরা সবাই মহিলা। আপনিই একমাত্র পুরুষ। উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, সংগ্রাম শেষ হয়নি। আমি বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি, আপনারা পাকিস্তানের ওপর এমন চাপ তৈরি করুন, যাতে এ যুদ্ধের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জেল থেকে ছেড়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও পেয়েছিলেন। কিন্তু আমেরিকা ও চীনের চাপে নতুন বাংলাদেশ সরকারকে বেশি দেশ স্বীকৃতি দেয়নি। আমার মনে আছে, ৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে ২৩ বা ২৪ তারিখ ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে বসেছিলাম।

উদ্দেশ্য ছিল, নতুন কারা কারা আসে তাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। হঠাৎ আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল নেপালের রাষ্ট্রদূত মাধব রিমলের। খাঁটি বাংলায় বললেন, আমি কলকাতায় পড়াশোনা করেছি। কথা প্রসঙ্গে বললেন, এই আমার ঠিকানা। দুপুরে আসুন। বড় খবর পাবেন। খবরটা কী তা তিনি খুলে বলেননি। ধানমন্ডিতে তার অফিসে গিয়ে দেখি শতাধিক গাড়ি। সব গাড়ির সামনেই পতাকা উড়ছে। রিমল আমাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বললেন, আজ ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ডেকেছিলাম। সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, ‘সমস্ত কূটনীতিকরা নিজ নিজ দেশকে বার্তা পাঠিয়ে জানাবে বর্তমানে নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে সরকারকে বৈধ ঘোষণা করে স্বীকৃতি দিতে।’ তিনি বললেন, পাকিস্তান আগেই চলে গেছে। চীন ও আমেরিকার রাষ্ট্রদূতরা আসেননি। আমরা তাদেরও এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছি। এতবড় খবর লিখে কলকাতায় পাঠানোর ব্যাপারে ইতস্তত করছিলাম। কামারুজ্জামান সাহেব তখন টেলিফোনমন্ত্রী। তিনি বললেন, তোমাকে গাড়ি পাঠাচ্ছি। এখনই চলে এসে আমার অফিস থেকে পাঠাও। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার কয়েক মাস পরে তিনি ইসলামী সম্মেলনে ইসলামাবাদ গিয়েছিলেন। এরপর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো ঢাকায় আসেন। তাকে প্রশ্ন করা হয়— এখনো বাংলাদেশে ১০ লাখ বিহারি মুসলমান আছেন, যারা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত। তাদের কবে ফিরিয়ে নেবেন, উত্তেজিত ভুট্টো বললেন, তাদের কাউকেই নেব না। পরের প্রশ্ন ছিল, বঙ্গবন্ধু আপনাদের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন। সেই ৫০০ কোটি টাকা কবে দেবেন? তিনি বললেন, আমি চেকবই নিয়ে আসিনি। পাকিস্তান সবকিছু লুট করে নিয়ে গেলেও তারা একটি বড় জিনিস রেখে গিয়েছিলেন তেজগাঁও বিমানবন্দরের মাটির তলায়। ৪০ টনের একটি বোমা। ভারতীয় বাহিনী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বোমাটি উদ্ধার করে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। যে কোনো সময় বড় বিমান তার ওপর দাঁড়ালে কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটতে পারত, তা ৪৬ বছর পরেও কল্পনা করা যায় না।

এদিকে যুদ্ধের সময় ইন্দিরা গান্ধী তার বিদেশ নীতি-নির্ধারক ডিপি ধর, পিএন হাকসার, টি এন কউল, আরএন কাউড় এবং সমর নায়ক শ্যাম মানেকশকে নিয়ে একটি কমিটি করেছিলেন। এই কমিটি হিন্দুস্তান হোটেলে বসে মুক্তিযুদ্ধের ওই চার নেতার সঙ্গে ঢাকা শহরে সিভিলিয়ান এলাকা চিহ্নিত করে দিতেন। যার ফলে সাধারণ মানুষ কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করার আগে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, অধ্যক্ষ, ছাত্র, নাগরিকদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। এর দারুণ প্রতিক্রিয়া আমরা ঢাকায় দেখেছি।

শুরুতেই বলা হয়েছে মার্চ মাস উল্লেখযোগ্য। বঙ্গবন্ধু ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। ফেব্রুয়ারি মাসে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ব্রিগেডে জনসভা করেন। তাদের মধ্যে আলোচনার শেষে কলকাতায় রাজভবনে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে ১৭ মার্চ আমার জন্মদিনে ইন্দিরা গান্ধীকে ঢাকা সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তিনি সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। ইন্দিরা গান্ধী উত্তরে বলেন, হ্যাঁ, কিন্তু একটি শর্ত আছে। শর্তটি হলো, ইন্দিরা বলেছেন, ১০ মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে সব ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার করে আনা হবে। একজন হাবিলদারও সেখানে থাকবে না। আমেরিকাকে বলতে দেব না যে, আমি ভারতীয় সেনাদের পাহারায় বাংলাদেশে গিয়েছি।

আমার মনে হয় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে ঐহিতাসিক সম্পর্ক তা আরও বেশি করে দুই বাংলার তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা দরকার। এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে দুই দেশেরই সংবাদমাধ্যম। ৪৬ বছর পর নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে দুই প্রতিবেশী দেশ। এ পরিস্থিতিতে ইতিহাসের আলোচনা ও তার থেকে শিক্ষা নেওয়া দুই দেশের কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ।

লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর