৮ নভেম্বর, ২০১৫ ১৭:২৮

মহাজোটের দখলে বিহার, বিপর্যস্ত বিজেপি

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

মহাজোটের দখলে বিহার, বিপর্যস্ত বিজেপি

বিহারে মুখ থুবড়ে পড়ল মোদি ব্রিগেড। শেষ হাসি হাসলেন নীতিশ কুমারই। ভোটের পর বেশিরভাগ বুথফেরত জরিপেই জনতা দল ইউনাইটেড-রাষ্ট্রীয় জনতা দল-কংগ্রেসের মহাজোটকে এগিয়ে রেখেছিল। হলোও তাই। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিহারের মসনদ দখল করলো মহাজোট। ২৪৩ আসনবিশিষ্ট বিহারের ম্যাজিক ফিগারকে (১২২টি আসন) টপকে অনেকটাই এগিয়ে গেছে মহাজোট। বিকেল চারটে পর্যন্ত গণনা শেষে রাজ্যের ২৪৩টি আসনের মধ্যে মহাজোট পেয়েছে ১২৫ টি আসন, এগিয়ে আছে আরও ৩৫টির বেশি আসনে। অন্যদিকে, বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট পেয়েছে ৩৬টি আসনে, এগিয়ে রয়েছে আরও ২৫টি আসনে এবং অন্যানরা ৫টি আসন পেয়েছে।  

গত ১২ অক্টোবর থেকে মোট পাঁচ দফায় চলে ভোট পর্ব। রবিবার ছিল ভোট গণনা। সকাল ৮টা থেকে শুরু হয় ভোট গণনা। প্রথম দুই-তিন ঘণ্টায় এনডিএ জোট এগিয়ে থাকলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই সেই ছবি পাল্টাতে থাকে। ক্রমশ এগোতে থাকে নীতিশ-লালুর বিজয়রথ। কিছুক্ষণের মধ্যে এনডিএ-র আসন সংখ্যাকে টপকে যায় মহাজোট। এরপরই পরিষ্কার হয়ে যায় বিহারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। পাটনায় নীতিশ এবং লালুর বাসার সামনে ভিড় জমাতে শুরু করেন দলের কর্মী-সমর্থকরা। আবির খেলা, বাজি ফাটানোর সঙ্গে সঙ্গেই চলে মিষ্টি মুখের পালা।

এবারের নির্বাচনে শুরুতে দুই পক্ষই উন্নয়নকে হাতিয়ার করে ভোট লড়াইতে নেমেছিল। একদিকে নরেন্দ্র মোদির জাদু, অন্যদিকে নীতিশ কুমারের সুশাসনের রেকর্ড-লড়াইটা এই জায়গাতেই সীমাবদ্ধ হচ্ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মহাজোট সেই লক্ষ্যে থাকলেও বিজেপি’র কট্টরপন্থী অংশ ‘হিন্দুত্ব’ তত্ত্ব সামনে নিয়ে আসে। গোমাংস থেকে শাহরুখ বিতর্ক কোনও কিছুই বাকী থাকেনি। মেরুকরণের রাজনীতি আর নিচুজাতের প্রচার হয়ে উঠেছিল বিজেপির এজেন্ডা। বিহারের সিংহাসন নিজের দখলে রাখতে প্রচারণাতেও ঝড় তুলেছিল এই গেরুয়া দলটি। কিন্তু সেই মেরুকরণ থেকে বিজেপি ফায়দা তোলার বদলে আরও অতলে চলে গেল বিজেপি। নীতিশ কুমারের দল যেখানে ২৩০টি সভা করেছিল, লালু প্রসাদ যাদবের দল যেখানে ২৫১টি সভা করেছিল সেখানে বিজেপির নেতাদের প্রচারণার সংখ্যা ছিল ৯০০ এর কাছাকাছি! কিন্তু সবকিছুই বিফলে গেল। এনডিএ জোটকে ফুঁ মেরে বিহারে সরকার গড়ল নীতিশ কুমার-লালু প্রসাদ যাদব-সোনিয়ার মহাজোট। 

সংখ্যালঘুরা মহাজোটের পক্ষেই ভোট দেয়। পাশাপাশি হিন্দুরাও মহাজোটের পক্ষে ছিল। তাছাড়া নীতিশ কুমারের মহাজোটের সবথেকে বড় ইতিবাচক দিক ছিল তার ১০ বছরের শাসনকালের উন্নয়ন। গোটা বিহারের কোনও এলাকায় ব্যক্তিগতভাবে নীতিশ কুমারের কোন নিন্দা শোনা যায়নি। তবে নীতিশের মাস্টার স্ট্রোক হল এই নির্বাচনে বিশ বছরের পুরোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ লালু প্রসাদ যাবদের হাত ধরা। নীতিশের নিজের কুর্মি শ্রেণির ভোট ছাড়াও লালুর হাতে ছিল মুসলিম ও যাদব ভোট। দলিত ভোটও নীতিশের কাছে কৃতজ্ঞ ছিল। আর সেটাকে কাজে লাগিয়েই বাজিমাত নীতিশের। তাছাড়া নীতিশ কুমারকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে মহাজোট নির্বাচনী প্রচারণায় নামলেও এনডিএ’র মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে কেউই ছিলেন না। জোটের মুখ বলতে ছিলেন কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তা নিয়েও ভোটাররা অনেকেই দ্বিধায় ছিলেন। 

জয়ের পরই নীতিশ কুমার জানিয়েছেন ‘মহাজোট একযোগে কাজ করে এই জয় এনেছে। এই জয়েই পরিস্কার যে বিহারবাসী আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু প্রত্যাশা করেন। এই জয়ে বিহারের প্রতিটি নাগরিককে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন বিহারের প্রতিটি শ্রেণির মানুষই আমাদেরকে সমর্থন জানিয়েছেন।

অন্যদিকে নীতিশ কুমারকে টেলিফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পরে টুইট করে মোদি নিজেই সেকথা জানিয়ে বলেন, ‘আমি নীতিশ কুমারকে ফোন করে এই জয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছি’। মোদির পাশাপাশি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়, জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা, দেশটির সাবেক অর্থমন্ত্রী কংগ্রেস নেতা পি.চিদাম্বরম প্রমুখ। টুইট করে বিজেপির পরাজয়কে ‘সহিষ্ণুতা জয় এবং অসহিষ্ণুতার পরাজয়’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। পাশাপাশি এই জয়ে নীতিশ কুমার, লালু প্রসাদ সহ পুরো টিম এবং বিহারবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন মমতা।

এই জয়কে সত্যের জয় বলে উল্লেখ করেছেন কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী। তিনি বলেন, বিজেপি এবং আরএসএস যে এই দেশকে ভাগ করতে পারবে না-সেই বার্তাই পেলেন মোদি। নরেন্দ্র মোদির অহঙ্কারের জন্যই বিহারে বিজেপির পরাজয় হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন রাহুল। 

সিপিআইএমএর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি জানান, ‘মোদি যে উন্নয়নের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিহারের রায়েই সেটা প্রমাণিত। তাছাড়া সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা যে মানুষ পছন্দ করেন না তাও পরিষ্কার হয়ে গেল। 

অন্যদিকে হারের দায় স্বীকার করে নিয়েছে বিজেপি। টুইট করে নীতিশকুমার এবং লালু প্রসাদ যাদবকে অভিনন্দন জানিয়ে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ জানান, ‘জনগণের রায়কে আমরা শ্রদ্ধা জানাই। নতুন সরকারের জন্য শুভকামনা রইল। আশাকরি এই সরকার বিহারকে আরও উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাবে’। হারের কারণ নিয়ে ইতিমধ্যেই বিশ্লেষণ শুরু করে দিয়েছে বিজেপির শীর্ষ কর্মকর্তারা। 

এদিকে মহাজোটের এই জয়ের ফলে মোদির রাজনৈতিক উচ্চতা একধাক্কায় অনেকটাই কমে যাবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। তার নিজের দলের মধ্যে থাকা মোদি বিরোধী শিবিরও নড়েচড়ে বসবে মোদির পতনের দিন গোনার অপেক্ষায়। পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতে এবং সরকারের বিজেপি আরও একঘরে হয়ে পড়বে। সংসদে বকেয়া একাধিক বিল রাজ্যসভায় সংখ্যালঘু থাকা সরকারের পক্ষে পাশ করানো আরও কষ্টকর হয়ে উঠবে এনডিএ-এর কাছে। কার্যত প্রতিটি পদক্ষেপেই সরকারের কাজে বাধা আসবে বিরোধীদের তরফে এবং বিরোধী জোট অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে যাবে এবং ভারতের রাজনীতিতে একদিনে নরেন্দ্র মোদি বনাম অন্য নেতারা-এই বিভাজনেই অগ্রসর হবে আগামীদিন।

বিহারের ভোটের ফলাফল নিয়ে এদিন কেবলমাত্র গোটা দেশে রাজনৈতিক মহলে তীব্র কৌতুহল তৈরি হয়েছিল তাই নয়, দেশেটির কর্পোরেট মহল থেকে অর্থ নীতির কারবার সকলেই তাকিয়ে ছিল এই ফলের দিকে। দেশ বিদেশের গণমাধ্যমও গুরুত্ব দিয়ে এই সংবাদ পরিবেশন করেছিল।

 

বিডি-প্রতিদিন/ ০৮ নভেম্বর, ২০১৫/ রশিদা

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর