২৭ আগস্ট, ২০১৬ ১২:১৭

চীনা নিশানায় ‘চিকেনস নেক’, শিলিগুড়ি রক্ষায় প্রস্তুত ভারত

অনলাইন ডেস্ক

চীনা নিশানায় ‘চিকেনস নেক’, শিলিগুড়ি রক্ষায় প্রস্তুত ভারত

মুরগির ঘাড় বেশ দুর্বল। মটকে দেওয়া গেলেই শরীর থেকে মাথা আলাদা হয়ে যেতে পারে। ভারতকে চাপে ফেলতে এ বার মুরগির ঘাড়েই নিশানা স্থির করছে চীন। চিকেন’স নেক বা শিলিগুড়ি করিডর নিয়ে যেন নিশ্চিন্ত না থাকে ভারত। চুম্বি উপত্যকা থেকে তেমনই বার্তা দিতে শুরু করেছে চীনের লাল ফৌজ। তবে চুম্বি উপত্যকা থেকে যে মুরগির ঘাড়ে আঘাত আসতে পারে, সে কথা ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও জানে। তাই প্রতিরোধের ব্যবস্থাও কিন্তু আগে থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছে।

চীনা প্রেসিডেন্ট তথা চীনের সেন্ট্রাল মিলিটারি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান শি জিনপিং পিপল’স লিবারেশন আর্মির দু’টি ইউনিটকে সম্প্রতি বিশেষ সম্মান দিয়েছেন। ওই দুই ইউনিটের শক্তিও দ্রুত বাড়ানো হচ্ছে। একটি হল দক্ষিণ চীন সাগরে মোতায়েন করা সাবমেরিন ইউনিট ৩৭২। অপরটি ভারতের সিকিম প্রদেশ এবং ভুটানের হা জেলার মাঝখানে অবস্থিত চীনের চুম্বি উপত্যকায় মোতায়েন থাকা ইউনিট ৭৭৬৫৬। চিনের সীমান্ত সুরক্ষিত রাখা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখার কাজে এই দুই ইউনিট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে চীনা প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন।

দক্ষিণ চীন সাগর এখন গোটা বিশ্বের কাছেই আলোচনার বিষয়। ওই অঞ্চলে চীনা আগ্রাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় চীনের বিপক্ষে তো গিয়েছেই। সবক’টি বড় সামরিক শক্তিও চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখা চীনের কাছে এখন মান-সম্মানের লড়াই। সেই দক্ষিণ চীন সাগরে মোতায়েন করা বাহিনীকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হল, চুম্বি উপত্যকায় মোতায়েন করা বাহিনীকেও চীনা প্রেসিডেন্ট সমগোত্রীয় গুরুত্ব দিলেন। এটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, চীনের পক্ষ থেকে ভারতের প্রতি একটি কড়া বার্তা এটি এমনটাই মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। ভারতকে চাপে রাখতেই চুম্বিতে আচমকা শক্তি বাড়াচ্ছে চীন, খবর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রের। কারণ চুম্বি উপত্যকার অবস্থান এমন একটি জায়গায়, যেখান থেকে চিকেন’স নেক-এ পৌঁছনো বেশ সহজ।

চিকেন’স নেক বা শিলিগুড়ি করিডর:
পূর্বে নেপাল, পশ্চিমে বাংলাদেশ। মাঝখানে খুব সঙ্কীর্ণ একটি অংশ ভারতের নিয়ন্ত্রণে। এতই সঙ্কীর্ণ অংশ সেটি যে একটু কল্পনার চোখে দেখলে ম্যাপে তাকে মুরগির ঘাড়ের মতো দেখায়। উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে দেশের বাকি অংশের যোগসূত্র হিসেবে অবস্থান করছে ওই এলাকা। শিলিগুড়ি, মাটিগাড়া, নকশালবাড়ি, ফাঁসিদেওয়া এবং চোপড়া ও ইসলামপুরের কিছুটা অংশ এই চিকেন’স নেকের মধ্যে পড়ছে। এই অংশকে শিলিগুড়ি করিডরও বলা হয়। কারণ উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে দেশের বাকি অংশের সড়ক ও রেল যোগাযোগের জন্য একমাত্র ভরসা ওই সঙ্কীর্ণ ভূখণ্ড। অনেকটা যেন করিডরের মতো শিলিগুড়ি ছুঁয়ে গিয়েছে, তাই এটি শিলিগুড়ি করিডর।

শিলিগুড়ি করিডরের গুরুত্ব:
উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় শহর শিলিগুড়ি। উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে দেশের অন্য যে কোন অংশের সঙ্গে যোগাযোগের প্রশ্নে শিলিগুড়ি একটা জংশনের মতো। ফলে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের কাছেই শিলিগুড়ির গুরুত্ব অপরিসীম। শিলিগুড়ি করিডরের আন্তর্জাতিক গুরুত্বও যথেষ্ট। নেপাল এবং ভুটানও বিশ্বের বাকি অংশের সঙ্গে যুক্ত থাকতে শিলিগুড়ি করিডরের উপর অনেকটা ভরসা করে। অর্থাৎ, ভারতের দুই অংশের মধ্যে সড়ক ও রেল যোগযোগ বজায় রাখা, উত্তর-পূর্ব ও অবশিষ্ট ভারতের মধ্যে ট্রনজিট পয়েন্ট হিসেবে কাজ করা এবং নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেন’স নেক অপরিহার্য।

চিকেন’স নেক হাতছাড়া হলে যা হতে পারে:
এই অঞ্চল ভারতের হাতছাড়া হলে উত্তর-পূর্ব ভারত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। উত্তরবঙ্গের তিনটি জেলারও একই হাল হবে। যে উত্তর-পূর্ব ভারত নিয়ে চীনের সঙ্গে বিস্তর টানাপড়েন, চিকেন’স নেককে নিজেদের কব্জায় নিয়ে সেই উত্তর-পূর্বকেই বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারলে চীনের পক্ষে লক্ষ্যে পৌঁছনো খুব সহজ।

চিকেন’স নেক-এর রক্ষাকবচ:
চীন যতই চাপ বাড়াক, ভারতীয় সেনার আত্মবিশ্বাসে কিন্তু কোন কমতি নেই। কারণ মুরগির ঘাড়কে সুরক্ষিত রাখতে ভারতের পক্ষ থেকে রক্ষাকবচও নেহাৎ কম নয়।

প্রথমত, শিলিগুড়ি করিডরে ঢুকতে হলে চীনা সেনাকে সিকিমের মধ্যে দিয়ে আসতে হবে। চীন এবং ভারতের সীমান্তে হিমালয় এত দুর্গম যে প্রাকৃতিক গিরিপথগুলি ছাড়া স্থলপথে চুম্বি উপত্যকা থেকে সিকিমে ঢোকার কোন পথ নেই। নাথু লা, জেলেপ লা, দংচু লা, বাতাং লা এবং ডোকা লা— মূলত এই পাঁচ গিরিপথ দিয়েই চুম্বি থেকে সিকিম হয়ে চিকেন’স নেকের দিকে আসা যায়। 

ডোকা লা চিকেন’স নেকের সবচেয়ে কাছে। চুম্বি থেকে ওই গিরিপথ দিয়ে সিকিমে ঢুকে খুব দ্রুত জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র জুলুক পর্যন্ত চলে আসা যায়। জুলুক পাহাড়ের ঠিক নীচ থেকেই পশ্চিমবঙ্গ তথা দার্জিলিঙের সীমানা শুরু। কিন্তু এত কাছে হওয়া সত্ত্বেও, গিরিপথের মুখ এক বার বন্ধ করে দেওয়া হলে, আর কোন পথ নেই। ভারত প্রতিটি গিরিপথের মুখেই ভারী সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। প্রয়োজন হলেই সবক’টি গিরিপথ বন্ধ করে দিতে ভারতীয় সেনার খুব একটা সময় লাগবে না।

দ্বিতীয়ত, চুম্বি উপত্যকা থেকে ভুটানের হা জেলা হয়ে সরাসরি পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্সে ঢুকে আসা সম্ভব চীনা সেনাদের পক্ষে। কিন্তু ভুটান একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র। ভারতের সঙ্গে ভুটানের সম্পর্কও ভাল। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হলে ভুটানের মধ্যে দিয়ে চীনা সেনাকে ভারতের দিকে এগোতে দেওয়া হবে, তেমনটা চীনও আশা করে না।

তৃতীয়ত, চুম্বি থেকে সিকিমের দিকে আসার আগেই যাতে চীনা সেনাকে রুখে দেওয়া যায়, তার ব্যবস্থাও রয়েছে। ভুটানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সেনার আদানপ্রদান প্রতিদিনের। ভুটানের সেনাবাহিনী পুণের ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমি এবং দেহরাদুনের ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেয়। বছরজুড়ে ভুটানে থেকে সে দেশের সেনাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ভারতীয় সেনার একটি শাখাও রয়েছে। ইন্ডিয়ান মিলিটারি ট্রেনিং টিম বা আইএমটিআরএটি নামে পরিচিত ভারতীয় সেনার সেই শাখা ভুটানের হা জেলায় সারা বছরই থাকে। ভুটানের মধ্যে ১৫০০ কিলোমিটার রাস্তা, সেতু, পারো বিমানবন্দর, ইয়াংফুলাতে একটি অব্যবহৃত বিমানঘাঁটি এবং বেশ কয়েকটি হেলিপোর্টের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও পালন করে ভারতের বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশন। তাই চুম্বি উপত্যকাকে ঘিরে যে ভারতীয় সেনার অবস্থান রয়েছে, তাও চীন জানে।

চতুর্থত, শিলিগুড়ি করিডর এবং গোটা ডুয়ার্স জুড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বায়ুসেনার উপস্থিতি ব্যাপক। সেনা এবং বিএসএফ-এর অনেকগুলি ইউনিট ওই এলাকায় বছরজুড়ে মোতায়েন থাকে। বাগডোগরা এবং হাসিমারায় দু’টি সুবিশাল বিমানঘাঁটিও রয়েছে ভারতের। ফলে চুম্বি উপত্যকার খুব কাছে অবস্থিত হলেও শিলিগুড়ি করিডরে পৌঁছনো চীনা সেনার পক্ষে মোটেই সহজ কাজ নয়।

ভারত বা চীন কেউই অবশ্য সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ানোর পক্ষে নয়। সীমান্তে শান্তি রাখতে নয়াদিল্লি এবং বেজিং দু’পক্ষই সচেষ্ট। কিন্তু কৌশলগত স্বার্থেই প্রস্তুতি এবং পাল্টা প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারছে না কোন পক্ষই।

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

বিডি প্রতিদিন/২৭ আগস্ট ২০১৬/হিমেল-১০

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর