২০ জুলাই, ২০১৭ ২২:০৩

কানপুর থেকে রাইসিনা হিলসের অন্দরমহল

দীপক দেবনাথ, কলকাতা:

কানপুর থেকে রাইসিনা হিলসের অন্দরমহল

সংগৃহীত ছবি

পাঁচ দশকেরও বেশি দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে প্রতিরক্ষা, অর্থ, বিদেশ রাজস্ব, শিল্প ও বাণিজ্যের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলিয়েও বীরভূম থেকে রাইসিনা হিলসে পৌঁছাতে বিদায়ী রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সময় লেগেছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর। সেখানে তার প্রায় অর্ধেক সময়েই কানপুর থেকে রাইসিনা হিলসে পৌঁছে গেলেন রামনাথ কোবিন্দ।
বৃহস্পতিবারই বিরোধী প্রার্থী মীরা কুমারকে হারিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনের পথ প্রশস্ত করেন এনডিএ প্রার্থী কোবিন্দ। উত্তরপ্রদেশের কানপুর থেকে দিল্লির রাইসিনা হিলসের দূরত্ব বড়জোড় ৪৫০ কিলোমিটার। বিভিন্ন কাজে তিনি রাইসিনা হিলসে গেছেন ঠিকই কিন্তু পাকাপাকি ভাবে পাঁচবছরের জন্য এই বাড়িটির কর্ণধার হবেন সেটা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেন নি কানপুরের প্রত্যন্ত পারাউখ গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান কোবিন্দ।
১৯৪৫ সালের ১ অক্টোবর উত্তরপ্রদেশের কানপুরের দেহাত জেলার পারাউখ গ্রামের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ভারতের ১৪ তম রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন তিনি(তার দুইটি বোনও রয়েছে)। তার বয়স যখন মাত্র পাঁচ ঠিক তখনই তার জীবনে সবচেয়ে আঘাতটি আসে। ঘরে আগুন লেগে যাওয়ায় মাকে হারাতে হয় সেই ছোট্ট বয়সেই। একদিকে ব্যক্তিগত ক্ষতি অন্যদিকে আর্থিক অক্ষমতা-দুইয়ে মিলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করাটাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিল। যদিও রাজ কিশোর সিং নামে এক সাবেক শিক্ষক সেসময় দেবদূতের মতো পাশে দাঁড়ান। কোবিন্দকে সঙ্গে করে নিয়ে গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করে দেন ওই সাবেক শিক্ষক। কিন্তু সেসময় মাধ্যমিক শিক্ষার (জুনিয়র স্কুল) জন্য প্রায় ৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হতো কানপুর গ্রামে, আর সেটা পায়ে হেঁটেই কারণ তখনকার দিনে ওই গ্রামে মোটরসাইকেল তো দূর, একটা সাইকেলও ছিল না গ্রামের কারও বাড়িতে।
স্বভাবতই দলিত কৃষক পরিবারের ছেলেটি কখনও রাজনীতিতে আসবেন সেটাও স্বপ্নেও ভাবেন নি কোবিন্দের পরিবার। কিন্তু সেটাই হল, একেবারে ভারতের সাংবিধানিক প্রধান! স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কানপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ডিএভি কলেজ থেকে বাণিজ্য ও আইন নিয়েও স্নাতক ডিগ্রি লাভের পরই দিল্লি চলে আসেন কেন্দ্রের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদ ‘সিভিল সার্ভিস’ পরীক্ষায় নিজেকে তৈরি করার জন্য। তৃতীয় বারের চেষ্টায় সেই পরীক্ষায় সফল হন। কিন্তু র‌্যাঙ্ক পিছনে হওয়ার কারণে আইএএস হতে না পারায় প্রশাসনিক পদে যোগ না দিয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং আইন প্র্যাকটিস চালিয়ে যান কোবিন্দ। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত দিল্লি হাইকোর্টে কেন্দ্রীয় সরকারের অ্যাডভোকেট হিসাবে কাজ করেন। এরপর ১৯৮০ থেকে ১৯৯৩ সালে সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকারের স্ট্যান্ডিং কাউন্সে’এর দায়িত্ব সামলান। এরমধ্যেই ১৯৭৮ সালে ভারতের শীর্ষ আদালতের অ্যাডভোকেট-অন-রেকর্ড হন তিনি। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৬ বছর ধরে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস চালিয়ে যান তিনি। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই’এর ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্বও সামলেছিলেন কোবিন্দ।
১৯৯১ সালে বিজেপিতে যোগদানের মধ্যে দিয়েই রাজনীতিতে প্রবেশ করেন কোবিন্দ। ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বিজেপি দলিত মোর্চা এবং অল ইন্ডিয়া কোলি সমাজ’এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র হিসাবেও কাজ করেছিলেন। এমনকি রাজনীতিকে ভালবেসে দেরাপুরের নিজের পৈত্রিক ভিটেটিকেও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)’কে দান করে দেন। ১৯৯৪ সালে উত্তরপ্রদেশ থেকে প্রথম রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত হন। পরপর দুই দফায় ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি সাংসদ ছিলেন। রাজ্যসভা হাউজ কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। সাংসদ তহবিলের রুপিতে উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখন্ডের গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার প্রসারে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। সাংসদ হিসাবে তিনি থাইল্যান্ড, নেপাল, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন দলিত সম্প্রদায়ের এই মানুষটি। ২০০২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ভাষণ দেওয়ার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার ঝুলিতে। ২০১৫ সালের ৮ আগষ্ট বিহারের রাজ্যপাল হিসাবে কোবিন্দকে নিয়োগ দেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। ১৬ আগস্ট রাজ্যপাল পদে শপথ নেন তিনি। আর সবচেয়ে বড় চমক এল ১৯ জুন। দেশজুড়ে যখন একের পর এক দলিত ও সংখ্যলঘুদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠছে ঠিক সেসময় একজন অত্যন্ত সুকৌশলে রাষ্ট্রপতি পদে দলিত মুখ রামনাথ কোবিন্দকেই বেছে নিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তবে এত উত্তোরণের মধ্যেও পরাজয়ের মুখও দেখতে হয়েছিল তাকে। বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপির টিকিটে উত্তরপ্রদেশের ঘাটমপুর ও ভোগনিপুর-এই দুইটি কেন্দ্র থেকে লড়াই করলেও পরাজিত হন কোবিন্দ। তবে এবার দেশটির চতুর্দশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে দেশের প্রথম নাগরিকের মর্যাদা পাবেন কোবিন্দ। কোবিন্দ হলেন দ্বিতীয় দলিত ব্যক্তি যিনি কে.আর.নারায়ণনের পর ভারতের রাষ্ট্রপতি পদ অলঙ্কৃত করবেন। এর আগে ১৯৯৭-২০০২ সাল পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব সামলেছেন নারায়ণন।
তবে রাষ্ট্রপতি পদে এনডিএর প্রার্থী হিসাবে কোবিন্দের নাম কোনদিনই আলোচিত হয়নি। বরং সেই জায়গায় একসময়ে দক্ষিণের সুপারস্টার রজনীকান্ত, বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, কেন্দ্রের তথ্যসম্প্রচার মন্ত্রী ভেঙ্কাইয়া নাইডু, ঝাড়খন্ডের রাজ্যপাল দ্রৌপদী মুর্মুর নাম উঠে এসেছিল বারবার। কিন্তু সব জল্পনাকে সরিয়ে কোবিন্দকেই তুরুপের তাস হিসাবে ব্যবহার করেন মোদি-অমিত শাহরা। দুই বারের সাংসদ ও বিহারের রাজ্যপাল হয়েও তিনি কখনওই প্রচারের আলোয় ছিলেন না। সুষমা বা ভেঙ্কাইয়া নাইডুর মতো কোবিন্দের নিজস্ব পরিচিতি ছিল না। তবে তার সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট হল আনুগত্য। আর মোদিও ঠিক এমন একজন মানুষই খুঁজছিলেন। তাইতো কোবিন্দের নাম ঘোষণার পর তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি তো বলেই ফেলেছিলেন “কে এই রামনাথ কোবিন্দ? তাকে কে চেনে?” আসলে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের অভিমত ছিল সাদামাটা জীবন যাপন করা কোবিন্দকে প্রার্থী করলে একদিকে শিবসেনা, বিহারের নীতিশকুমার, ওড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কদের পাশে পাওয়া যাবে ঠিক তেমনি এই প্রথম এক হিন্দুত্ববাদীকে দেশের সর্বোচ্চ আসনে বসানো যাবে এবং দেশের দলিত, অনগ্রসর ও তফসিলি সম্প্রদায়ের মন জয় করা। কারণ আগামী বছর দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন এবং তারপরই ২০১৯ সালে লোকসভার নির্বাচন। তাতে বিজেপির প্রধান টার্গেট দলিত, অনগ্রসর, তফসিলিদের কাছে টানা।  
আগামী ২৫ জুলাই নতুন রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেবেন কোবিন্দ। ওইদিন তার বাড়ি থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনের সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি বিশেষ সম্মানের সঙ্গে সংসদ ভবনে নিয়ে যাবে কোবিন্দকে। এরপর সংসদের সেন্ট্রাল হলে শপথ নেবেন নতুন রাষ্ট্রপতি। তাকে শপথ বাক্য পাঠ করাবেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধানবিচারপতি জগদীশ সিং খেহর। এরপর প্রথামাফিক নিজের উত্তরসূরিকে আসন ছেড়ে দেবেন বিদায় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। এরপর নতুন রাষ্ট্রপতি রওনা দেবেন রাইসিনা হিলসের অন্দরে।

বিডি প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর