১৯ আগস্ট, ২০১৭ ১৩:১৬

ইউরোপজুড়ে আতঙ্কের কারণ গাড়ি-হামলা

অনলাইন প্রতিবেদক

ইউরোপজুড়ে আতঙ্কের কারণ গাড়ি-হামলা

সংগৃহীত ছবি

ইউরোপজুড়ে গাড়ি হামলার সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে গাড়িই হয়ে উঠছে আতঙ্কের কারণ।  সাম্প্রতিক সময়ে মূলত জনবহুল এলাকাতেই চালানো হয়েছে এসব হামলা।  ফ্রান্সের নিস, জার্মানির বার্লিন, যুক্তরাজ্যের ওয়েস্টমিনিস্টারের পর সর্বশেষ স্পেনের বার্সেলোনা সাক্ষী থাকলো একই ধরণের গাড়ি হামলার। এই প্রতিটা সন্ত্রাসী হামলার জন্য ব্যবহার করা হয়নি কোনও বিস্ফোরক বা মারণাস্ত্র। বরং মানুষ হত্যার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় গাড়ি । 

বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত চার বছরে ইউরোপ মুলুকের বিভিন্ন অঞ্চলে আটটি গাড়ি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় ১২৯ জন নিহত ও আহত হয়েছেন প্রায় ১২৭ জন। ইউরোপজুড়ে এই সন্ত্রাসী হামলাগুলোর বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই দায় স্বীকার করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী তথাকথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস)।


বিবিসির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ১৪ জুলাই বাস্তিল দিবসে ফ্রান্সের নিস শহরে জনতার ওপর ট্রাক হামলা চালায় তিউনিশিয়ান এক নাগরিক। এ হামলায় ৮৬ জন নিহত হন। একই বছরের ১৯ ডিসেম্বর জার্মানির বার্লিনের ব্রেইটসিডপ্লাজে ক্রিস্টমাস মার্কেটের ভেতরে ট্রাক চালিয়ে ১২ জনকে হত্যা করেন আনিস আমরি নামের এক তিউনিশিয়ান নাগরিক। চলতি বছরের ২২ মার্চ লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজে পথচারীদের ওপর মাইক্রোবাস তুলে দিয়ে হামলা চালানো হয়। এতে চারজন নিহত হন। এ সময় হামলাকারী পাশেই থাকা এক পুলিশ সদস্যকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।

গত ৭ এপ্রিল সুইডেনের স্টকহোমে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মধ্যে লরি চালিয়ে চারজনকে হত্যা করা হয়। উজবেকিস্তানের এক নাগরিক এই হামলা চালান। আর গত ৩ জুন তিনজন জিহাদি লন্ডন ব্রিজে পথচারীদের ওপর কাভার্ডভ্যান চালিয়ে দিয়ে আটজনকে হত্যা করে। এরপর হামলাকারীরা এক পথচারীকে ছুরিকাঘাত করে আহত করে।

এ ছাড়া জুন মাসের ১৯ তারিখ লন্ডনের ফিনসবুরি পার্কে মসজিদের বাইরে মুসলিমদের ওপর কাভার্ডভ্যান হামলা চালানো হয়। এতে একজন নিহত হন। গত ৯ আগস্ট ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সেনাসদস্যের একটি দলের ওপর বিএমডব্লিউ গাড়ি চালিয়ে হামলা করে। এতে ছয়জন আহত হন। আর সর্বশেষ বৃহস্পতিবার স্পেনের বার্সেলোনায় হামলার ঘটনা ঘটল।

সর্বশেষ স্পেনের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার দুপুরে বার্সেলোনার লাস রামব্লাসে পথচারীদের ভিড়ে ভ্যান উঠিয়ে দেওয়ার ঘটনায় ১৩ জন নিহত হন। এরপর স্থানীয় সময় মধ্যরাতের দিকে ক্যামব্রিলসের কাছে আরেকটি হামলার প্রচেষ্টা হলে পাঁচ সন্দেহভাজনকে হত্যার মধ্য দিয়ে তা ঠেকিয়ে দেওয়ার দাবি করে পুলিশ। ওই ঘটনায় সাতজন আহত হন। তাদের মধ্যে ছয়জন পথচারী ও একজন পুলিশ। এই দুই হামলার আগে বৃহস্পতিবার সকালে আলকানার এলাকার একটি বাড়িতে বিস্ফোরণ হয়। এতে একজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। এটিকে প্রথমে দুর্ঘটনা বলে মনে করা হলেও এখন পুলিশ ধারণা করছে তিনটি ঘটনার সংযোগ রয়েছে। 

এই হামলার পর সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হলো। কোনও রেস্টুরেন্ট কিংবা ঘরের কাছে রাস্তাতেও এখন আর কেউ নিরাপদ নন। যেকোনও সময় যেকোনও স্থানেই হামলার শিকার হতে পারেন মানুষ। আর এসব হামলা চালানোর জন্য খুব বড় কোনও অস্ত্রের দরকার নেই। গাড়িই হয়ে উঠতে পারে ভয়ংকর অস্ত্র। গত দুই বছরে এমন বেশ কয়েকটি হামলা হয়েছে।

কয়েক বছরের গবেষণায় দেখা গেছে যে, কোনো সমাজে আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য খুব সাধারণ পথ ব্যবহার করলেই হয়। আর এই গাড়িহামলা সেই আতঙ্কই তৈরি করছে। লন্ডনে ওয়েস্টমিনিস্টারে হামলাটি আত্মঘাতী কিংবা আধা-আত্মঘাতী। ছিল না অতিরিক্ত প্রযুক্তিনির্ভরতা, লাগেনি ভারী অস্ত্র। ফ্রান্সের নিস ও বার্লিনে বড়দিনের মার্কেটের হামলার কায়দায় গাড়ি ব্যবহৃত হয়। ওই দুই হামলায় চালক কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেনি। এর আগে ২০১৩ সালে উলউইচ ব্যারাকে লি রিগবি নামের এক সেনাকে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। ফলে বিষয়টি এখন একেবারে স্পষ্ট হয়ে গেছে, সন্ত্রাসী হামলা চালাতে একটি গাড়িই যথেষ্ট। আর তাতেই ছড়িয়ে পড়বে আতঙ্ক। এমন হামলা ঠেকানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও খুব বেশি কিছু করার থাকে না।

আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, অনেকে মনে করেন হামলাকারীরা নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠী, ধর্ম ও গ্রুপের হওয়ার কারণে তারা হামলার ভয় বেশি পান। তারা নিজেদের পরিচয় নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। সামাজিক বৈষম্যেরও শিকার হতে থাকেন তারা। সামাজিক বিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘আউটগ্রুপিং’। আর পশ্চিমাদের লক্ষ্য করে এই হামলা আউটগ্রুপিংয়ের কারণেই হয়ে থাকে। এই অনুভূতি আসলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরির মাধ্যমে সমাজকে বিভক্ত করে ফেলে। বিভিন্ন ধর্ম ও গোষ্ঠীর মানুষদের মাঝে বিভেদ তৈরি করে।

এই সকল গবেষণা থেকে জানা যায়, এমন হামলার কারণে বিশ্বাস ও ঐক্যের ফাটল দেখা যায়। যেটা সমাজের জন্য আরো ক্ষতিকর। এটা হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে অতটা ক্ষতিকর মনে হয় না। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব খুবই গভীর। পশ্চিমা রাজনীতিতে এর প্রভাব যাই হোক না কেন পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। নগরজীবনের মানসিকতার পট পরিবর্তন হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে হামলার আশঙ্কা। সাধারণ যেকোনো বস্তুকেই মনে হচ্ছে অস্ত্র।

আর এই ভয় ও আতঙ্ক সমাজ ও রাজনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে। ইউরোপে সাম্প্রতিক সময়ের এই হামলাগুলো এমনই স্বাক্ষ্য দেয়। যার ফলে ইউরোপের বেশিরভাগ মানুষই মুসলিম প্রধান দেশগুলোর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পক্ষে।

 

 

বিডি প্রতিদিন / ১৯ আগস্ট, ২০১৭ / তাফসীর‌

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর