২২ জানুয়ারি, ২০১৮ ২২:১৪

মনোরোগের মহামারীতে ভুগছে চীন!

অনলাইন ডেস্ক

মনোরোগের মহামারীতে ভুগছে চীন!

সংগৃহীত ছবি

উ ইয়নহং (৪২)। চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জিয়াংজি প্রদেশের বাসিন্দা। ১১ বছর ধরে তিনি ছোট একটি লোহার খাঁচায় বন্দী। খাঁচাও তাকে আটকে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়, তাই মোটা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে তার পা।  

মূলত, ১১ বছর আগে প্রহার করতে করতে এক তরুণকে মেরে ফেলেন ইয়নহং। এর পর থেকেই তার খাঁচায় বন্দী জীবন।  তার মায়ের দাবি, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত তার ছেলে। তাই ইয়নহংকে কিছুতেই বাইরে রাখতে চান না তার মা। 

ইয়নহংয়ের মতো আরেকজন চেংদু।  তিনি বিষণ্নতার রোগে ভুগছেন।  চীনের এই বাসিন্দা এতটাই বিষণ্ন ছিলেন যে নিজেকে চিড়িয়াখানার জোড়া রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কাছে নিজেকে সপে দিতে ঢুকে পড়েছিলেন বাঘের খাঁচায়।

চেংদু, ইয়নহংয়ের মতো এরকম শত শত ঘটনার খবর চীনা গণমাধ্যমে প্রায়ই আসে।  এর মূলে রয়েছে অত্যাধিক কাজের চাপ, প্রথাগত পরিবার-কাঠামো ভেঙে যাওয়া এবং দ্রুত আধুনিকায়ন।  যা সে দেশের জনগণের মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। এরফলে মানসিক রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে অতি দ্রুত। এদের দ্বারা ঘটছে আক্রমণ, সহিংসতা, হত্যা ও আত্মহত্যার ঘটনা। মানসিক স্বাস্থ্য সেবার চাহিদা মেটাতে গিয়ে চীনের গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে হিমশিম খাচ্ছে এটা তার খন্ড চিত্র। 

ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল দ্য ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত একটি গবেষণার ফলাফল অনুসারে, চীনের ১৭৩ মিলিয়ন লোক মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। প্রতি এক লাখ লোকের জন্য গড়ে মানসিক ডাক্তার রয়েছে মাত্র দেড়জন, যা কি-না যুক্তরাষ্ট্রের এক-দশমাংশ। চীনে মানসিক ডাক্তারের মোট সংখ্যাটা মাত্র ২০ হাজার। 

সাংহাইয়ের জিয়াও টং বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন্টাল হেল্থ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক মাইকেল ফিলিপস জানিয়েছেন, মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে, চীনের এমন লোকদের মাত্র ৫ শতাংশ পেশাদার মনোচিকিত্সকের কাছ থেকে সেবা নিতে পারছেন। তার মতে, মানসিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, মানসিক স্বাস্থ্য সেবার অপর্যাপ্ততা, কলঙ্কের ভয়, চিকিত্সার অধিক খরচ এবং বস্তুত ডাক্তার দেখিয়ে কিছু হয় না এমন মনোভাব জটিল রোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

যথাযথ মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অপর্যাপ্ততার সুযোগে নামসর্বস্ব ও অযোগ্য (এক কথায় হাতুড়ে) ডাক্তার ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।  

হংকং সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের হংকং-ভিত্তিক চেয়ারম্যান ড. স্যামি চেং কিন-উইং জানিয়েছেন, চীনের মনোচিকিত্সা সম্পর্কে প্রচুর অভিযোগ। বিশেষত অনিবন্ধিক মনোবিদরা অপেশাদার উপদেশ দিয়ে ক্লায়েন্টদের বিপদ আরো বাড়িয়ে দেন। চীনের মূল ভূখণ্ডে অনেক মনোচিকিত্সকেরই প্র্যাকটিস জমজমাট। এদের একটা অংশ সু-প্রশিক্ষিত; কিন্তু তারা সংখ্যালঘু। মনোচিকিত্সার প্রচুর চাহিদা থাকায় অযোগ্যরা খুব সহজেই তাদের ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারছেন। এদের বাতলানো চিকিত্সায় বেশিরভাগ রোগীরই অবস্থার অবনতি ঘটে।  এতে ক্ষেপে গিয়ে রোগীর আত্মীয়-স্বজন নামসর্বস্ব ডাক্তারকে মারধোর করেছে— এমন ঘটনা মোটেও বিরল নয়।
 
যাদের সত্যিই সাহায্যের প্রয়োজন অথচ অর্থাভাবে সঠিক চিকিত্সা গ্রহণ করতে পারছে না, তাদের কিছুদিন আগেও সরকার জোর করে মানসিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠিয়ে দিয়ে প্রকারান্তরে বন্দী করে রাখত। রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত থাকতেই সরকার এ কাজটি করত— এমন অভিযোগ মানবাধিকার কর্মীদের। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর জ্যেষ্ঠ গবেষক নিকোলাস বেকুউলিনের তথ্যানুসারে, মানসিক রোগীদের বেলায় এমন পদ্ধতি চীনে বলবত্ ছিল কয়েক দশক, যা কি-না মেডিক্যাল ইথিকসের স্পষ্ট লঙ্ঘন। মানবাধিকার কর্মী জিং শিকু জানিয়েছেন, মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তাকে ছয় বছর আটকে রাখা হয়েছিল হাইলংজিয়াং প্রদেশের একটি হাসপাতালে। এ ধরনের মানসিক প্রতিষ্ঠানকে চীনে বলা হয় “আংকাং” হাসপাতাল। আংকাং শব্দের অর্থ শান্তি ও স্বাস্থ্য। কিন্তু ওই হাসপাতালগুলোতে আদৌ শান্তি ছিল কি-না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ২০১১ সালেও চীনে আংকাং হাসপাতাল ছিল মোট ২০টি। এগুলোয় চিকিত্সা বলতে ছিল কেবল মারপিট আর বৈদ্যুতিক শক। চীনের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কমিশন অবশ্য এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে। 

তাদের দাবি, মনোরোগীদের চিকিত্সা করা হত সকল নিয়ম-কানুন মেনেই। আংকাং হাসপাতালগুলো পরিচালনার দায়িত্বে ছিল সেদেশের জননিরাপত্তা ব্যুরো।

সুখবর হচ্ছে, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ব্যাপক অর্থায়নের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে চীনের সরকার। তারই অংশ হিসেবে গত বছর সূচিত হয়েছে একটি মানসিক স্বাস্থ্য আইন, যেটি পাস করতে লেগে গেছে ২৭ বছর। নতুন এ আইন অনুসারে কোনো মানসিক রোগী না চাইলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা যাবে না। এতে যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে তা হচ্ছে, প্রয়োজন হবে প্রচুর প্রশিক্ষিত মনোচিকিত্সকের। কিন্তু সে পরিমাণ প্রশিক্ষিত মনোচিকিত্সক তৈরি করতে চীনের বহু বছর লেগে যাবে।
 
হেরি হফমান ও তার স্ত্রী টিনা চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিংয়ে কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি প্রাইভেট প্র্যাকটিস কোচিং করান। ব্যবসার অংশ হিসেবে ওইসব ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দেন, যারা থেরাপিস্ট হতে চান। কিছুদিন আগে চেংদু থেকে আসা একটি যুবক বলেছিল, ‘মনোবিজ্ঞানে মাস্টার্স পাস করলেও ইনার ফিলিংস ও ইমোশান্স সম্পর্কে কিছুই শিখিনি। আমাকে কী ওই যোগ্যতাগুলো অর্জনে সাহায্য করবেন।’ হফম্যানের মতে, মানসিক থেরাপি হচ্ছে শিল্পের মতো। এতে অনেক কিছুই মেনে চলতে হয়। আনাড়িদের পরামর্শ মানলে লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। সেজন্য সব সময় প্রশিক্ষিত লোকের সাহায্য চাওয়া উচিত। কিন্তু মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়ার পর চীনের অধিকাংশ ব্যক্তি এ কাজটি করে না।
 
চীনে মানসিক সমস্যায় সবচে বেশি ভুগছে অভিবাসী শ্রমিকরা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর চীনস্থ পরিচালক সোফি রিচার্ডসন মনে করেন পরিবার-পরিজন ছেড়ে অনেক দূরের ফ্যাক্টরি-জীবনের কারণেই তাদের অনেকের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ছে। একঘেয়ে জীবনযাপন দূর করতে পারলেই এ সমস্যা অনেকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

বিডিপ্রতিদিন/ ২২ জানুয়ারি, ২০১৮/ ই জাহান

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর