৫ জানুয়ারি, ২০১৬ ১৪:২৫
ধর্মতত্ত্ব

ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ

মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা

ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ

ইসলাম মানব জাতির জন্য আল্লাহ-প্রদত্ত একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। তাই মানুষের জৈবিক কার্যক্রমের পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনাও এতে পাওয়া যায়। একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী সুন্দর সমাজ গড়তে ইসলামে কিছু জিনিসকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেগুলো দৃশ্যত মানব জাতির জন্য কল্যাণকর মনে হলেও আসলে তা মানবসমাজে বিশৃঙ্খলা বিস্তারের শক্ত হাতিয়ার। মানব জাতিকে আর্থিক ও চারিত্রিক ধ্বংসের মুখ থেকে রক্ষা করতে ইসলাম যে কটি জিনিসকে নিষিদ্ধ করেছে তার অন্যতম একটি হচ্ছে সুদ।

প্রাথমিক অবস্থায় মানুষ অভাবের তাড়নায় সুদি লেনদেনে জড়িয়ে পড়লেও এখন তা স্বভাবে পরিণত হয়েছে। যার ফলে এখন আর একে অপরাধ মনে করা হয় না। অথচ হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে— : হজরত জাবির (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল (সা.) সুদ গ্রহীতা, দাতা ও সুদি কারবারের লেখক এবং সুদি লেনদেনের সাক্ষী— সবার ওপর লানত করেছেন। (মুসলিম, হাদিস ৪১৩৮)।

রসুলের (সা.) পক্ষ থেকে এত বড় হুঁশিয়ারি আসার পরও আজ আমরা এ জঘন্য অপরাধ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারছি না। যার কারণে আমরা এতটাই অধঃপতনের শিকার যে আমরা গুনাকে গুনা-ই মনে করি না। হজরত ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমান (রহ.) বলতেন, ‘গুনা থেকে বিরত থাক! যদি কোনো কারণে গুনা হয়েও যায় তবে তাকে গুনা মনে কর! অন্যথায় তুমি তওবার সুযোগও পাবে না।’

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমরা অধিক মুনাফার লোভে পড়ে আজ সব ইসলামী নির্দেশনাকেও অস্বীকার করতে শিখে গেছি। কাঁচা টাকার গন্ধে মোহিত হয়ে আমরা এ বলতেও দ্বিধা করি না, ‘সব ক্ষেত্রে ধর্মকে টানবেন না’, ‘আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি আছে কিন্তু তা সব ক্ষেত্রে প্রয়োগ চলবে না’ ইত্যাদি।

কিন্তু একটু চিন্তা করলে দেখা যায়, ইসলাম যে বিষয়গুলোকে নিষিদ্ধ করেছে তার একটিও মানব জাতির জন্য কল্যাণকর নয়। তা কোনো না কোনোভাবে জাতির জন্য ভীষণ ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। যা আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা বুঝতে পারি না। আর এ স্বল্প জ্ঞানে আল্লাহর আইনকে যুক্তির আদালতে দাঁড় করানোর চেষ্টাও কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

সুদ অর্থকে ধ্বংস করে ও সাদকা বৃদ্ধি করে : অনেকের ধারণা, সুদভিত্তিক লেনদেনই পারে আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিতে কিংবা দারিদ্র্য বিমোচন করতে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় এটি চরিত্র বিমোচন ও অশান্তি আনয়নের একটি মাধ্যম। একজন মানুষ যখন সুদের ঘানি টানতে টানতে বাস্তুভিটাহারা হয়ে যায়, সুদের চাপে দিশাহারা, ব্যবসায়িক পণ্যে যখন অধিক মূল্য বসে যায় তখন জৈবিক চাহিদা পূরণের সব উপকরণই মানুষের সাধ্যের বাইরে চলে যায়। আর তখনই চরিত্রকে কবর দেওয়া ছাড়া মানুষের আর কিছুই করার থাকে না। বেড়ে যায় চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, ঘুষ ইত্যাদি। এসবের মূলে রয়েছে সুদভিত্তিক লেনদেনের মাধ্যমে দ্রুত বড়লোক হওয়ার মিথ্যা স্বপ্ন। অথচ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে : আল্লাহতায়ালা সুদকে ধ্বংস করে দেন এবং দান-সাদকাকে বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহতায়ালা কোনো অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালোবাসেন না। (সুরা বাকারা, আয়াত ২৭৬)।

অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে : ‘আর তোমরা যে সুদ দিয়ে থাক, মানুষের সম্পদে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য তা মূলত আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। আর তোমরা যে জাকাত দিয়ে থাক আল্লাহর সন্তুষ্টির কামনা করে (তা-ই বৃদ্ধি পায়) এবং তারাই বহুগণ সম্পদপ্রাপ্ত। (সুরা রুম, আয়াত ৩৯)।

উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায়, যদি কোনো সমাজে ইসলামী অর্থব্যবস্থা চালু এবং জাকাত-ফিতরা ও অন্যান্য সাদকা সঠিকভাবে আদায় করা হয়, তবে ওই সমাজে আল্লাহর রহমত ও সাহায্য শতভাগ থাকবে। এতে সমাজ যেমন চারিত্রিকভাবে শুদ্ধি লাভ করতে পারবে তেমন দরিদ্রতাও সমাজকে মুক্তি দিতে বাধ্য হবে। সঙ্গে সঙ্গে জাকাত-সাদকা আদায়কারীর ধনসম্পদকে বহু গুণে উন্নীত করার ঘোষণা খোদ আল্লাহতায়ালাই দিয়েছেন। অতএব এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

সুদের শাস্তি : সুদ কতখানি জঘন্য তা উম্মতকে জানান দিতে রসুল (সা.) ইরশাদ করেন : সুদের গুনার সত্তরটি স্তর রয়েছে, তার মধ্যে সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে আপন মাকে বিয়ে (মায়ের সঙ্গে জিনা) করা। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৭৪)।

এ জঘন্য কাজের শাস্তি কতটা ভয়াবহ হবে তার চিত্র আল্লাহতায়ালাই কোরআনে উপস্থাপন করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে : যারা সুদ খায়, তারা তার মতো (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচাকেনা সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ ব্যবসা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হলো, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওয়ালা। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী-জাহান্নামি। তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে। (সুরা বাকারা, আয়াত ২৭৫)।

এখনো সময় আছে : কোরআনের ইরশাদ : আর যদি তোমরা সুদ পরিত্যাগ না কর তবে আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও। আর যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা জুলুম করবে না এবং তোমাদের জুলুম করা হবে না। (সুরা বাকারা, আয়াত ২৭৯)। সুদ খাওয়া বা দেওয়া আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ করার নামান্তর। যারা সুদের লেনদেন করবে তারা অভিশপ্ত। কিন্তু আল্লাহ অধিক দয়ালু। তিনি আমাদের রক্ষার জন্য হাজারো পথ রেখে দিয়েছেন। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে অপরাধ হয়ে গেলেও আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য তওবার পথ রেখে দিয়েছেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক


বিডি-প্রতিদিন/ ০৫ জানুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা

সর্বশেষ খবর