১৮ মার্চ, ২০১৬ ১৪:৩৬

নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার নামই ইসলাম

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার নামই ইসলাম

নৈতিকতার চরম অবক্ষয় চলছে বিশ্বজুড়ে। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। খবরের কাগজ কিংবা টেলিভিশন খুললেই আঁতকে ওঠার মতো খবর চোখে পড়ে। কিন্তু কোনো খবরেই আঁতকে উঠি না আমরা। জাগে না আমাদের বিবেক। নাড়া দেয় না হৃদয়। ‘সন্তানের হাতে মা-বাবা খুন অথবা মা-বাবার হাতে সন্তান খুন’— এমন সংবাদ এখন আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। সহি বুখারিতে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস বলছি। রসুল (সা.) বলেছেন, সময় নিকটবর্তী হতে থাকবে, আর আমল কমতে থাকবে। কার্পণ্য ছড়িয়ে দেওয়া হবে এবং ‘ফিতনা’র বিকাশ ঘটবে। ‘হারজ’ ব্যাপকতর হবে। সাহাবিরা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হারজ’ কি? রসুল (সা.) বললেন, ‘হত্যা! হত্যা।’ (বুখারি)। জাতির এই কঠিন সময়ে আলেম ও ধর্মদিল বান্দাদের মানুষের পাশে দাঁড়ানো সময়ের দাবি। জাতি আজ পবিত্র আত্মা এবং সৎ মানুষের সংকটে ভুগছে। জাতির এ আধ্যাত্মিক বিপর্যয়ে দরদী বন্ধুর ভূমিকা পালন করতে না পারলে আমাদের ধর্ম-দ্বীন পূর্ণ হবে না। আমরা প্রকৃত ধার্মিক হতে পারব না। প্রকৃত ধার্মিক হতে হলে প্রত্যেকের জন্য হৃদয়ে দরদ তৈরি করতে হবে। আত্মায় মানবতা চর্চা করতে হবে। মানুষের দুঃখে দুঃখী হতে হবে। পল্লী কবি জাসীমউদ্দীন খুব চমৎকারভাবে বলেছেন, ‘সবার সুখে হাসব আমি/কাঁদব সবার দুঃখে/নিজের খাবার বিলিয়ে দেব/অনাহারির মুখে।’ ধর্ম কাকে বলে জানে না আজকের ধার্মিক। তাই আজ ধার্মিকের হাতেই ধর্ম সবচেয়ে অনিরাপদ। নির্দিষ্ট পোশাক আর অর্চনার মতো সকাল বিকাল মন্দির-মসজিদে দৌড়ালেই ধার্মিক হওয়া যায় না। ধার্মিক হতে হয় কর্ম করে। মানবতার কল্যাণে কাজ করলেই ধার্মিক হওয়া যায়।

কাজের পাশাপাশি হৃদয়ে মানব প্রেম ও দরদ থাকা চাই। সবসময় মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখাই প্রকৃত ধর্ম ও ধার্মিকের কাজ। সহিহ মুসলিম থেকে দুটি হাদিস শোনাচ্ছি। হজরত তামীম দারি (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আদদ্বীনুন নাসিহা— অর্থাৎ ধর্ম হলো মঙ্গল কামনা করা।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রসুল! কার জন্য মঙ্গল কামনা করব?’ রসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ, কিতাব ও রসুলের প্রতি ইমানের ব্যাপারে মঙ্গল কামনা করবে। আর প্রত্যেকে মুসলমান, সাধারণ ও নেতাদের জন্য কল্যাণ কামনা করবে।’ (মুসলিম।) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী (রহ.) লেখেন— ধর্মের প্রাণ হলো মঙ্গল কামনা করা। যেমন বলা হয় হজের প্রাণ হলো আরাফায় অবস্থান করা। অর্থাৎ আরাফায় অবস্থান না করলে যেমন হজ হয় না তেমনি অন্তরে অন্যের কল্যাণের ইচ্ছা না থাকলে ধর্ম হবে না। (শরহে মুসলিম, ২য় খণ্ড, ৩৭ পৃষ্ঠা)। জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘আমি রসুল (সা.)-এর কাছে নামাজ কায়েম করা, জাকাত আদায় করা এবং প্রত্যেক মুসলমানের জন্য কল্যাণ কামনা করার বাইয়াত-অঙ্গীকার করেছি।’ (মুসলিম)। প্রত্যেকের জন্য কল্যাণ কামনা করা ধর্মের মৌলিক একটি বিষয়। কারণ একটি সুস্থ-সুন্দর সমাজের প্রথম দাবি হলো— এখানে বসবাসকারী কোনো ব্যক্তি অন্যের কারণে ক্ষতির স্বীকার হবে না এবং নিজেও অন্য কারও ক্ষতি করবে না। আর এটা তখনই সম্ভব হবে যখন কেউ কারও অমঙ্গল চাইবে না। সমাজের সবাই যখন হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে একে অপরের কল্যাণ কামনা করবে আর আল্লাহর বিধান মেনে চলবে তখন আল্লাহতায়ালা প্রত্যেকের আত্মায় প্রশান্তি নাজিল করবেন। এমন সমাজ ও দেশের মানুষদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর কল্যাণের দরজা উন্মুক্ত করে দেবেন। কোরআন বলছে, ‘দেশের জনগণ যদি আল্লাহর ওপর ইমান আনত এবং তাকে ভয় করার নীতি অবলম্বন করত, তবে আকাশ ও পৃথিবীর কল্যাণের দরজা তাদের জন্য খুলে দেওয়া হতো। (সূরা আ’রাফ : ৯৬)।

ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশে আজ অধর্মের চর্চা হয় ধার্মিকেরই হাতে। মায়ের কোলে শিশু খুন হয় মায়ের আঁচলের ফাঁসে। মানুষ আজ মানুষ নেই। চতুষ্পদ জন্তুও হার মানছে মানুষের কাছে। কয়েক দিন আগে পত্রিকায় দেখেছি, ধান ক্ষেতে ফেলে যাওয়া সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুকে একটি কুকুর মুখে নিয়ে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছে। সূরা আ’রাফের ১৭৯নং আয়াতটির কথা মনে পড়ে গেল। আল্লাহ বলেন, ‘তারা পশুর মতো বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট। এরাই ওইসব লোক যারা গাফিলতির মধ্যে পড়ে আছে।’ খবরটি অনেকেরই নজরে পড়েছে হয়তো কিন্তু বিবেকে নাড়া দেয়নি কারও। গভীরভাবে চিন্তার বিষয়, কেন মায়ের কোল শিশুর জন্য অনিরাপদ হয়ে গেল? সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানীরা বিষয়টি নানাভাবে ব্যাখ্যা করলেও আমি মনে করি এর অন্যতম কারণ হলো— আমাদের সমাজে পরস্পরের কল্যাণ কামনার মানসিকতা কমে গেছে। মানুষ এখন বিভিন্নভাবে পরের অমঙ্গলের চিন্তায় ব্যস্ত রয়েছে। অথচ আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন মানুষের মঙ্গলের জন্য। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। তোমাদের বের করা হয়েছে মানুষের কল্যাণ ও উপকারের জন্য। তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে, অসৎ কাজের নিষেধ করবে এবং আল্লাহর ওপর ইমান রাখবে।’ (সূরা আলে ইমরান : ১১০)। খোদার সৃষ্ট মানব বাগানে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য আমাদের প্রত্যেককে অপর বান্দার জন্য ভাবতে হবে। একটি মানব ফুলও যেন অন্যায়ভাবে ঝরে না পড়ে পৃথিবী থেকে সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে সবাইকে। শান্তিকামী মানুষকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।  হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘সাবধান! তোমরা সবাই দায়িত্বশীল। তোমাদেরকে তোমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। (মুত্তাফাকুন আলাইহি)।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসিসরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর