৬ জুলাই, ২০১৮ ১৩:৫৪
ধর্মতত্ত্ব

হজরত ওমর (রা.)-এর জন্য ওয়ায়েস কারনির নসিহত

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

হজরত ওমর (রা.)-এর জন্য ওয়ায়েস কারনির নসিহত

শান্তির খোঁজে হয়রান গোটা দুনিয়ার মানুষ। মানুষ কি জানে শান্তি কোথায়? শান্তি থাকে আত্মায়। নিজের ভিতরে। মন যখন শান্ত হয় আত্মায় তখন প্রশান্তির বৃষ্টি ঝরে। এ ধরনের মানুষকে বলা হয় প্রশান্ত আত্মার মানুষ। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে তাদের কাছে। আসে আত্মা প্রশান্ত করার সবক নিতে। সুফিসম্রাট ওয়ায়েস আল কারনি (রহ.) ছিলেন এমনই একজন প্রশান্ত আত্মার মানুষ। সুফিরা লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করেন। মানুষ তাদের খুঁজে নেয়। শুধু যে সাধারণ মানুষ তাদের কাছে আসে তাই নয়, কখনো কখনো বিশেষ মানুষও তাদের কাছে আসে। তাদের আসরে বসে। জ্ঞানসমুদ্রের নুড়ি কুড়িয়ে বাড়ি ফেরে। এমনই একটি ঘটনা আজ পাঠকদের শোনাচ্ছি।

খলিফা হওয়ার পর হজরত ওমর (রা.) এলেন ওয়ায়েস আল কারনি (রহ.)-এর আস্তানায়। নজদের গারা মরুভূমির এই আস্তানায় আসতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল ওমর (রা.)-কে। ওয়ায়েস আল কারনি তখন এক মনে  নামাজ পড়ছিলেন। দীর্ঘ সময় পর নামাজ শেষ হলো। সালাম ফিরিয়েই দেখেন পেছনে ওমর (রা.) বসে আছেন। প্রিয় নবী (সা.)-এর সাহাবি ওমর (রা.)। খুব আদবের সঙ্গে বললেন, ওমর! আপনি কেমন আছেন? এই ফকিরের আস্তানায় আসার কারণ কী, জানতে পারি?

মুচকি হেসে ওমর (রা.) বললেন, হুজুর! আমি শুনেছি আপনি রসুল (সা.)-কে অসম্ভবরকম ভালোবাসেন। ওহুদের ময়দানে রসুল (সা.)-এর দাঁত মুবারক শহীদ হয়েছে শুনে আপনি নিজের সব দাঁত ভেঙে ফেলেছেন। ওয়ায়েস কারনি (রহ.) বললেন, আপনি ঠিক শুনেছেন। এই দেখুন, আমার মুখে একটি দাঁতও নেই— বলেই মুখ হাঁ করলেন নবীপ্রেমিক ওয়ায়েস কারনি।

ওমর (রা.) চোখ বড় বড় করে দাঁতহীন মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, সুবহানাল্লাহ! এরপর হজরত ওমর আবার প্রশ্ন করলেন, হুজুর! আপনি কেন নবীজির সঙ্গে দেখা করেননি? আপনার বাড়ি তো নবী (সা.)-এর বাড়ি থেকে খুব দূরে ছিল না।

এবার মুচকি হাসি হাসলেন আল্লাহর অলি ওয়ায়েস আল কারনি (রহ.)। বললেন, ওমর! দয়ালের প্রেম খেলা এরকমই। তিনি কাউকে দূরে থেকেও কাছে রাখেন। আবার কাউকে কাছেও রেখেও দূরে রাখেন। আচ্ছা, আপনিও তো মারেফাতের ছাত্র একজন। আপনিই বলুন না, এই চামড়ার চোখ দিয়ে দেখাই কি আসল দেখা, নাকি মনের চোখ দিয়েই আসল দেখা যায়?

ওমর (রা.) বললেন, মনের চোখ দিয়ে দেখাই আসল দেখা। হে ওয়ায়েস! আমাকে কিছু উপদেশ দিন।

ওয়ায়েস আল কারনি (রহ.) বললেন, হে অর্ধপৃথিবীর শাসক ওমর! আপনি যদি আল্লাহর কাছে প্রিয় হতে পারেন, তবে আর কারও কাছে প্রিয় হওয়ার প্রয়োজন নেই। আবার আল্লাহ যদি আপনার কাছে প্রিয় হয়ে যান, তাহলে আর কাউকেই প্রিয় করার প্রয়োজন নেই আপনার। জেনে রাখবেন, জীবনে-মরণে একজনই আপনজন। তিনি হলেন আল্লাহ। আল্লাহ ছাড়া আমাদের প্রকৃত আপন-প্রিয়জন কেউ নেই। সব সময় তাঁর ধ্যানে, তাঁর খেয়ালে থাকবেন। হৃদয়ে অনন্ত প্রশান্তির ঝরনাধারা বয়ে চলবে তখন। তৃপ্তির জীবন আপনার কাছে ধরা দেবে তখন।

ওমর (রা.) বললেন, হে আল্লাহর অলি! আপনার এই নসিহত আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। আমি জানতে পেরেছি, আপনার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। বায়তুলমাল থেকে আপনার জন্য এক ব্যাগ স্বর্ণমুদ্রা এনেছি। দয়া করে এগুলো রাখুন।

খলিফার আচরণ দেখে কেন যেন মুখের হাসি উবে গেল ওয়ায়েস কারনির। তিনি বললেন, হে ওমর! আমি অবসরে শ্রমের কাজ করি। মানুষের উট চড়াই। এখনো আমার পকেটে দুটি মুদ্রা আছে। আপনি কি নিশ্চয়তা দিতে পারেন, এ দুটি মুদ্রা খরচ করার আগে আমার মৃত্যু হবে না? ওমর (রা.) খুব লজ্জা পেলেন। তিনি বললেন, এ নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারবে না হে আল্লাহর ফকির। ওয়ায়েস কারনি বললেন, তাহলে কীভাবে আমি আপনার মুদ্রাভর্তি ব্যাগটি নিতে পারি?

ওমর (রা.) বললেন, সুবহানাল্লাহ! কী চমৎকার তায়াক্কুল আপনার। এবার একটু রেগে গেলেন আল্লাহর অলি। তিনি বললেন, হে ওমর! প্রশংসা করতে হলে আল্লাহর করুন। বান্দার নয়। এ বলেই ওয়ায়েস কারনি ফের নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন।

হে পাঠক! এ ধরনের মানুষের জীবন থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। মরা আত্মায় কীভাবে প্রশান্তির বৃষ্টি ঝরাব, এসব ফকিরের জীবন থেকেই আমরা শিখতে পারি। হে আল্লাহ! আমাদের প্রশান্তিময় জীবন পরিচালনার তাওফিক দান কর।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। চেয়ারম্যান : বাংলাদেশ মুফাসিসর সোসাইটি।

www.selimazadi.com
 
বিডি প্রতিদিন/এনায়েত করিম

সর্বশেষ খবর