মুমিনের অভ্যাস হলো শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে যাওয়া। সম্ভব হলে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া। সেটি সম্ভব না হলে অন্তত ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। তারপর এ দোয়াটি পড়া—‘আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আহইয়ানা বাদা মা আমাতানা ওয়া ইলাইহিন নুশুর।’
অর্থ : সেই আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা, যিনি মৃত্যুর পর আমাদের জীবন দান করলেন এবং তাঁরই দিকে আমাদের পুরুত্থান। (বুখারি, হাদিস : ৬৩১৪)
এরপর ইস্তিঞ্জা করা। পেশাব-পায়খানার পর পবিত্রতা অর্জনকে ‘ইস্তিঞ্জা’ বলা হয়। পেশাব-পায়খানার জন্য নির্ধারিত স্থানে যাওয়ার আগে নিম্নের দোয়াটি পড়া
উত্তম : ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজু বিকা মিনাল খুবুসি ওয়াল খাবাইস।’
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি মন্দ কাজ ও শয়তান থেকে আপনার আশ্রয় চাই।
পায়খানা বা ইস্তিঞ্জার পর ডান পা আগে দিয়ে বের হয়ে নিম্নের দোয়াটি পড়া উত্তম : ‘আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আজহাবা আন্নিল আজা ওয়া ফানি।’
অর্থ : সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমার থেকে কষ্ট দূর করেছেন এবং স্বস্তি দান করেছেন।
মুখ পরিষ্কার করা : ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে, নামাজের আগে, কোনো মজলিসে যাওয়ার আগে এবং কোরআন-হাদিস পাঠ করার আগে মিসওয়াক বা ব্রাশ করে মুখ পরিষ্কার করা মুস্তাহাব।
(মারাকিল ফালাহ : ৫৩)
অজু করা : অজুকে নামাজের চাবি বলা হয়েছে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘নামাজের চাবি পবিত্রতা।’
(আবু দাউদ : ৬১)
তাই অজুর ফরজ, সুন্নত, মুস্তাহাব ইত্যাদির প্রতি ভালোভাবে খেয়াল করে অজু সম্পন্ন করা চাই।
ফজরের নামাজ পড়া : প্রথমে দুই রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা আদায় করা। অতঃপর ফজরের দুই রাকাত ফরজ নামাজ আদায় করা।
কোনো কারণে ফরজের আগে সুন্নত পড়তে না পারলে, সূর্য উদিত হওয়ার পর পড়ে নেবে। ফরজ নামাজ বা জামাতের পরপরই এ সুন্নতের জন্য দাঁড়ানো যাবে না। (দুররুল মুখতার : ২/৫৭)
আর সূর্যোদয় অবস্থায় নামাজের জন্য দাঁড়ানো যাবে না, বরং সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পর নামাজে দাঁড়াতে হবে। ফজর নামাজ পড়া অবস্থায় সূর্য উঠে গেলে সেই নামাজ সূর্যোদয়ের পর কাজা পড়ে নিতে হবে। (রদ্দুল মুহতার : ২/৩২-৩৩)
ফজরের পর করণীয়
ফজরের পর পড়ার মতো ফজিলতপূর্ণ অনেক আমল রয়েছে। যেগুলো পড়ে মুমিন বান্দা নানা ধরনের উপকার লাভ করতে পারে। নিম্নে কতিপয় আমল উল্লেখ করা হলো—
আয়াতুল কুরসি পড়া : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে, তার জান্নাতে প্রবেশের পথে মৃত্যু ছাড়া আর কোনো অন্তরায় থাকবে না।’ (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ২৩৯৫)
আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের দোয়া : যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যা তিনবার নিম্নের দোয়া পাঠ করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সন্তুষ্ট করবেন। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৩৮৯)
দোয়াটি হলো ‘রাজিতু বিল্লাহি রব্বাওঁ ওয়াবিল ইসলামী দ্বিনাওঁ ওয়াবি মুহাম্মাদিন নাবিয়্যা।’
অর্থ : আমি আল্লাহকে রব হিসেবে, ইসলামকে দ্বিন হিসেবে ও মুহাম্মাদ (সা.)-কে নবী হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট।
সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার : যদি কেউ দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সকাল-সন্ধ্যা সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার পড়ে এবং ওই দিনে বা রাতে ইন্তেকাল করে, তবে সে জান্নাতি হবে। (বুখারি : ৬৩০৬)
জাহান্নাম থেকে মুক্তির দোয়া : যে ব্যক্তি ফজর ও মাগরিবের পর সাতবার নিম্নের দোয়াটি পাঠ করে এবং ওই দিনে বা রাতে তার মৃত্যু হয়, তাহলে সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৭৯)
দোয়া : ‘আল্লাহুম্মা আজিরনি মিনান নার।’
অর্থ : হে আল্লাহ! আমাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করুন।
পেরেশানি থেকে মুক্তির দোয়া : যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যা নিম্নের আয়াতটি সাতবার পাঠ করবে তাকে সব পেরেশানি থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।
(আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৮১)
আয়াতটি হলো ‘হাসবি ইয়াল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়া আলাইহি তাওয়াক্কালতু ওয়াহুয়া রাব্বুল আরশিল আজিম।’ অর্থ : আমার জন্য আল্লাহ যথেষ্ট, যিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। আমি তাঁর ওপর ভরসা করলাম। আর তিনিই মহান আরশের অধিপতি।
বালা-মুসিবত থেকে হেফাজতের দোয়া : নবীজি (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি দিন ও রাতের শুরুতে তিনবার নিম্নের দোয়াটি পড়বে, ওই দিন ও রাতে কোনো অনিষ্ট তাকে স্পর্শ করবে না। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৪৭৪)
দোয়াটি হলো ‘বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মাআসমিহি শাইয়ুং ফিল আরদি ওয়া লা ফিস সামায়ি ওয়া হুওয়াস সামিউল আলিম।’
অর্থ : আল্লাহর নামে শুরু করছি, যাঁর নামে শুরু করলে আসমান-জমিনের কোনো বস্তু ক্ষতি সাধন করতে পারে না। আর তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
সৃষ্ট বস্তুর অনিষ্ট থেকে হেফাজতের দোয়া : যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যা নিম্নের দোয়াটি তিনবার পাঠ করবে, সে সব কষ্টদায়ক প্রাণী থেকে হেফাজতে থাকবে।
(মুসলিম : ২৭০৯)
দোয়াটি হলো ‘আউজু বিকালিমা তিল্লাহিত তাম্মাতি মিন শাররি মা খালাক।’
অর্থ : আমি আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ কালিমাসমূহের দ্বারা সব সৃষ্টির অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাচ্ছি।
এ ছাড়া সৃষ্ট বস্তুর অনিষ্ট থেকে বাঁচতে সকাল-সন্ধ্যা সুরা ইখলাস তিনবার, সুরা ফালাক তিনবার এবং সুরা নাস তিনবার পাঠ করা সুন্নত।
সুরা ইয়াসিন পড়া : হাদিসে সুরা ইয়াসিন পড়ার অনেক ফজিলত বর্ণিত আছে। প্রতিদিন সকালে আমরা সুরা ইয়াসিন পড়তে পারি।
সূর্যোদয়ের পর করণীয়
সূর্যোদয়ের ২৩-২৪ মিনিট অতিবাহিত হলে ইশরাকের নামাজ পড়া সুন্নত। ইশরাকের নামাজ দুই বা চার রাকাত। এর নিয়ম সাধারণ নফল নামাজের মতোই। এ নামাজ পড়ার দ্বারা পূর্ণ একটি হজ ও ওমরাহ পালনের সওয়াব পাওয়া যায়। সব সগিরা গুনাহ মাফ হয়ে যায়। এর নিয়ত এমন : নবীর সুন্নত দুই রাকাত ইশরাকের নামাজ পড়ছি, আল্লাহু আকবার।
ইশরাকের পর করণীয়
ইশরাক নামাজ পড়ে নাশতা করা। জীবন-জীবিকার তাগিদে যার যার দুনিয়াবি কাজে নেমে পড়া। দায়িত্ব পালনে যত্নবান হওয়া। কাজে ফাঁকি না দেওয়া। যার যার কাজে ইসলামী বিধান খেয়াল রাখা। হতে পারে তা ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি কিংবা অন্য যেকোনো পেশার কাজ। তবেই সবার কাজ ইবাদতে পরিণত হবে।
ঘর থেকে বের হওয়ার দোয়া পড়া : যদি কেউ ঘর থেকে বের হওয়ার সময় নিম্নের দোয়াটি পড়ে, তবে সে যাবতীয় অনিষ্ট থেকে হেফাজতে থাকে, শয়তানের ধোঁকা থেকে দূরে থাকে। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৪২৬)
দোয়া : ‘বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ।’
অর্থ : আল্লাহর নামে, আল্লাহ তাআলার ওপরই নির্ভর করলাম, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই, শক্তিও নেই।
চাশতের নামাজ পড়া
কাজের কোনো ফাঁকে সম্ভব হলে চাশতের নামাজ পড়ে নেওয়া। চাশতের নামাজ দুই বা চার রাকাত, চার রাকাত পড়াই উত্তম। এর নিয়মও সাধারণ নফল নামাজের মতো। সূর্য এক-চতুর্থাংশ ওপরে উঠলে, গ্রীষ্মকালে ৯টা-১০টা, আর শীতকালে ১০টা-১১টা সময় সাধারণত তা আদায় করা হয়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে তিনটি বিষয়ের অসিয়ত করেছেন, যা আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনো ছাড়ব না। তার একটি হলো চাশতের নামাজ। (বুখারি, হাদিস : ১১৭৮)
এর নিয়ত হলো নবীর সুন্নত দুই রাকাত চাশতের নামাজ পড়ছি, আল্লাহু আকবার।
প্রতিদিন কোরআন তিলাওয়াত করা
প্রতিদিন কোরআন তিলাওয়াত করা। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কোরআন তিলাওয়াত করো। কেননা কোরআন কিয়ামতের দিন তিলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ৮০৪)
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আম্বরশাহ আল
ইসলামিয়া, কারওয়ান বাজার, ঢাকা
বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ