ইসলামে জীবিকা নির্বাহের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে কিছু মানুষের ধারণা এই যে সাহাবায়ে কিরাম শুধু আল্লাহর দ্বিনের জন্য তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এবং জীবিকা নির্বাহের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা এমন নয়। নিঃসন্দেহে সাহাবায়ে কিরাম তাঁদের জীবন আল্লাহর দ্বিন প্রতিষ্ঠায় উৎসর্গ করেছিলেন আবার একই সঙ্গে তাঁরা জীবিকা নির্বাহের কাজেও নিয়োজিত ছিলেন।
মক্কার সাহাবায়ে কিরাম (রা.) বেশির ভাগ ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন এবং মদিনার সাহাবিরা বেশির ভাগ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নবীযুগে সাহাবায়ে কিরামের বিভিন্ন পেশা তুলে ধরা হলো—
প্রহরী
এমন কয়েকজন সাহাবির নাম উল্লেখ করা হলো যাঁরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হেফাজতের উদ্দেশ্যে প্রহরীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১. মক্কায় যখন রাসুল (সা.) হাজরে আসওয়াদের কাছে নামাজ আদায় করতেন, তখন ওমর (রা.) তাঁর নামাজ শেষ না করা পর্যন্ত তরবারি হাতে নিয়ে পাহারা দিতেন। (আল ইলাল, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৩২)
২. সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পাহারাদারের দায়িত্ব পালন করেছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৭৩১)
৩. সাদ বিন মুআজ (রা.) বদর যুদ্ধের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অস্থায়ী বাসস্থান পাহারা দিয়েছিলেন। (তাখরিজুদ দালালাতিস সামইয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৪৫৬)
৪. আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) খাইবার যুদ্ধের পর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তাঁবুর বাইরে পাহারা দিতেন। এমনকি তিনি বনি কুরাইজার যুদ্ধেও পাহারার দায়িত্ব পালন করেছেন। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৪৫৭-৪৬৩)
পশু পালক (রাখাল)
মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উট চরাতেন।
(তাখরিজুদ দালালাতিস সামইয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৪৬৬)
চিঠি লেখক
জায়েদ বিন সাবিত (রা.) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মুখপাত্র, অর্থাৎ তিনি বিভিন্ন বাদশাহকে চিঠি লিখতেন এবং সেই রাজাদের পাঠানো চিঠির জবাবও লিখতেন। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে জায়েদ (রা.) ১৭ দিনে সিরিয়াক ভাষা শিখেছিলেন। তিনি ফারসি, রোমান, কপটিক ও আবিসিনীয় ভাষা জানতেন। (তাখরিজুদ দালালাতিস সামইয়্যাহ, পৃষ্ঠা-২১৮)
কালেক্টর (জাকাত আদায়কারী)
রাসুলুল্লাহ (সা.) অনেক সাহাবিকে মানুষের কাছ থেকে জাকাত আদায়ের জন্য পাঠিয়েছিলেন।
১. উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) মানুষের কাছ থেকে জাকাত আদায় করতেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২২৭৭)
২. খালিদ বিন সাঈদ (রা.) বনু জুবাইদা গোত্রের মানুষের কাছ থেকে জাকাত আদায় করতেন। (আল মাআরিফ, পৃষ্ঠা-২৯৬)
৩. মুআজ বিন জাবাল (রা.) ইয়েমেনে গভর্নর হয়ে জাকাত, জিজিয়া, রক্তপণ আদায় করতেন। (জামে আত-তিরমিজি, হাদিস : ৬২৩)
৪. উবাই বিন কাব (রা.) জাকাত আদায়কারী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৫৮৩)
৫. আদি বিন হাতেম (রা.) কয়েকটি নির্দিষ্ট গোত্রের মানুষের কাছ থেকে জাকাত আদায় করতেন।
(তাখরিজুদ দালালাতিস সামইয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৫৪৩)
চিকিৎসক ও ডাক্তার
১. হারিস বিন কালাদাহ (রা.) অত্যন্ত দক্ষ চিকিৎসক ছিলেন এবং তাঁকে ‘তাবিব আল-আরব’ (আরবের ডাক্তার) বলা হতো। (তাখরিজুদ দালালাতিস সামইয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৬৭১)
২. রিফাআহ বিন ইয়াসরিবি (রা.) রাসুল (সা.)-এর যুগে প্রসিদ্ধ একজন ডাক্তার ও সার্জন ছিলেন।
(তাখরিজুদ দালালাতিস সামইয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৬৬৮)
কবিরাজ
১. আবু সাঈদ আল খুদরি (রা.) এক গোত্রপ্রধানকে সাপে কামড়ালে সুরা ফাতিহার মাধ্যমে ঝাড়ফুঁক করেন।
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৭৩৬)
২. ইলাকাহ বিন সুহার (রা.) ঝাড়ফুঁক দিয়ে রোজগার করেছেন। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩৮৯৬)
হিজামাকারী
১. আবু তাইবা আল হাজ্জাম (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হিজামা করেছিলেন তথা শিঙা লাগিয়েছেন এবং রাসুল (সা.) তাঁকে দুই সা শস্য দান করেছিলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৬৯৬)
২. সালিম বিন আবি সালিম আল হাজ্জাম (রা.) মহানবী (সা.)-এর হিজামা করেছিলেন। (আল ইসতিয়াব ফি আসমাইল আসহাব, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৪১)
৩. ইয়াসার আবু হিন্দ আল হাজ্জাম (রা.) শিঙা লাগাতেন। (আল ইসাবাহ ফি তাময়িজিস সাহাবা, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-৪৪৭)
গোরখনক
১. আবু উবাইদা ইবনে জাররাহ (রা.) সিন্দুকি কবর (যেভাবে সাধারণত আমাদের দেশে কবর তৈরি করা হয়) খনন করতেন।
২. আবু তালহা আল আনসারী (রা.) মদিনায় বগলি কবর খনন করতেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৩৯)
শ্রমিক বা মজদুর
১. আবু মাসউদ (রা.) বাজারে গিয়ে বোঝা বহন করতেন। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২৫২৯)
আবু হুরায়রা (রা.) ছিলেন বুশরা বিনতে গাজওয়ানের মজদুর (শ্রমিক), পরে আবু হুরায়রা (রা.) তাঁকে বিয়ে করেন। (আল ইসাবাহ ফি তাময়িজিস সাহাবা, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-৫৩৭)
২. আবু আকিল (রা.) দুই সা খেজুরের বিনিময়ে পিঠে (অন্য স্থানে) পানি বহন করে নিয়ে যেতেন। এক সা খেজুর তাঁর পরিবারের জন্য রাখতেন এবং এক সা খেজুর দান-খয়রাত করতেন। (আল ইসাবাহ ফি তাময়িজিস সাহাবা, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-২৭৯)
রাজমিস্ত্রি
১. রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং সাহাবায়ে কিরাম (রা.) মসজিদে কুবা ও মসজিদে নববী নির্মাণ করেছেন। ইতিহাসে মসজিদে কুবা হলো সর্বপ্রথম মসজিদ, যা নবী (সা.) প্রতিষ্ঠা করেছেন।
২. তালক বিন আলী ও আবু আলী (রা.)-ও অন্য সাহাবায়ে কিরামের সঙ্গে মসজিদুল হারাম নির্মাণে অংশ নিয়েছিলেন। (আল ইসাবাহ ফি তাময়িজিস সাহাবা, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৫৩৮)
৩. ইসলামী যুগের প্রথম স্থপতি ছিলেন আম্মার বিন ইয়াসির (রা.)। (তাখরিজুদ দালালাতিস সামইয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৭২১)
লেদার ক্লিনার
হারিস ইবনে সাবিরা (রা.) ছিলেন ট্যানার। (অর্থাৎ চামড়া পরিষ্কার করতেন)।
(তাখরিজুদ দালালাতিস সামইয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৭২৩)
কামার
১. আবু ইউসুফ বারা বিন আওস (রা.) ছিলেন ইব্রাহিম বিন মুহাম্মদ (সা.)-এর পালক পিতা। তিনি কামারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। (আল ইসাবাহ ফি তাময়িজিস সাহাবা, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-১৯৭)
২. খাব্বাব (রা.) জাহেলি যুগে একজন কামার ছিলেন। তিনি তলোয়ার ইত্যাদি তৈরি করতেন।
(আল ইসতিয়াব ফি আসমাইল আসহাব, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২৬১)
বর্তন খোদাইকারী
আবু রাফি (রা.) হাঁড়ি খোদাই করতেন। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আজাদকৃত গোলাম ছিলেন। (আল ইসতিয়াব ফি আসমাইল আসহাব, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৪০১, তাখরিজুদ দালালাতিস সামইয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৭১২)
কাঠমিস্ত্রি
যুদ্ধের সময় মহানবী (সা.) মানজানিকের (Catapult) সাহায্যে পাথর নিক্ষেপ করেছিলেন। আর মানজানিক নিঃসন্দেহে সাহাবায়ে কিরাম তৈরি করেছেন। (তাখরিজুদ দালালাতিস সামইয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৭১১)
দর্জি
উসমান বিন তালহা (রা.), যাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) বাইতুল্লাহর চাবি দিয়েছিলেন। তিনি দর্জির কাজ করতেন।
(আল মাআরিফ, পৃষ্ঠা-৭৭৫)
কাঠুরিয়া
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের কারো পক্ষে এক বোঝা লাকড়ি সংগ্রহ করে পিঠে বহন করে নেওয়া কারো কাছে চাওয়ার চেয়ে উত্তম। কেউ দিতেও পারে, নাও দিতে পারে।
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০৭৪)
খেজুর বিক্রেতা
নাবহান আত তাম্মার (রা.), যিনি মদিনায় খেজুর বিক্রি করতেন। (আল ইসাবাহ ফি তাময়িজিস সাহাবা, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৪১৮)
শস্য বিক্রেতা
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : যে ব্যক্তি শস্য ক্রয় করে, সে যেন তা গ্রহণ করার আগে (অন্যের কাছে) না বিক্রি করে।
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৮৪৫)
তীর কেস ও ধনুক বিক্রেতা
হিমাস বিন আমর আল লাইসি (রা.) তীর কেস ও ধনুক বিক্রি করতেন।
(আল ইসাবাহ ফি তাময়িজিস সাহাবা, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৫৩)
ক্রীতদাস বিক্রেতা
আবুল জুয়াইজিয়াহ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে ক্রীতদাস বিক্রি করতেন।
(আল ইসাবাহ ফি তাময়িজিস সাহাবা, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-৬৬)
সবজি বিক্রেতা
আবু শাইবা আল খুদরি (রা.) সবজি বিক্রি করতেন।
(উসদুল গাবাহ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৩২)
আতর বিক্রেতা
ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেন, আমি যদি ব্যবসায়ী হতাম, তাহলে আমি আতরের ব্যবসা করতাম। কারণ তা থেকে যদি মুনাফা না-ও হতো, তবে আমি এর সুগন্ধি পেতাম।
(আত তামসিল ওয়াল মুহাদারাহ, পৃষ্ঠা-২৮৬)
বাইতুল মালের কোষাধ্যক্ষ
আবু উবাইদা ইবনে জাররাহ (রা.) আবু বকর (রা.)-এর খিলাফতকালে বাইতুল মালের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন।
(আল আকদুল ফারিদ, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৯)
বিলাল (রা.) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কোষাধ্যক্ষ। তবে ইতিহাসবেত্তারা বলেন, তিনি আবু বকর (রা.)-এর কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। (আল ইসতিয়াব ফি আসমাইল আসহাব, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১১২, আল ইসাবাহ ফি তাময়িজিস সাহাবা, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩২৬)
আবু বকর সিদ্দিক ও ওমর (রা.) উভয়েই নিজ নিজ খিলাফতকালে মুয়াইকিব (রা.)-কে বাইতুল মালের কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। (আল ইসতিয়াব ফি আসমাইল আসহাব, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৮১)
আবদুল্লাহ ইবনে আরকাম (রা.) ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে বাইতুল মালের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন এবং উসমান (রা.)-এর খিলাফতকালেও তিনি দুই বছর বাইতুল মালের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন, তারপর তিনি পদত্যাগ করেন। (আল ইসতিয়াব ফি আসমাইল আসহাব, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৫১৬)
ওমর (রা.) তাঁর খিলাফতকালে ইবনে মাসউদ (রা.)-কে ইরাকে পাঠান ইরাকবাসীর নামাজে ইমামতি করার জন্য; তাদের দ্বিনের বিধি-বিধান শিক্ষা দিতে এবং তাদের অর্থ দপ্তরের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে। (আল আমওয়াল, পৃষ্ঠা-৪৬)
উসমান ইবনে আফফান (রা.) জায়েদ ইবনে সাবিত (রা.)-কে বাইতুল মালের কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ করেন। (আল ইসতিয়াব ফি আসমাইল আসহাব, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩২২)
বিডি প্রতিদিন/নাজিম