মিসরের বিখ্যাত নারী মুহাদ্দিস, হাদিস সংকলক ও লেখক ছিলেন মারিয়াম বিনতে আহমদ (রহ.)। তিনি ৭১৯ হিজরিতে কায়রোতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম মারিয়াম বিনতে আহমদ বিন কাজি শামসুদ্দিন মুহাম্মদ বিন ইবরাহিম বিন ইবরাহিম বিন দাউদ আজরায়ি মিসরি হানাফি। তাঁর পূর্বপুরুষরা আজরাআতে বসবাস করত বলে তাঁকে আজরায়ি, তিনি মিসরে জন্মগ্রহণ করেন বলে তাঁকে মিসরি এবং হানাফি মাজহাবের অনুসারী ছিলেন বলে হানাফি বলা হতো।
তাঁর পরিবার ধর্মীয় জ্ঞানচর্চা, পাণ্ডিত্য ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের জন্য বিখ্যাত ছিল।
মারিয়াম বিনতে আহমদ (রহ.)-এর দাদা কাজি শামসুদ্দিন মুহাম্মদ (রহ.) সিরিয়ার আজরাআ থেকে হালবে আসেন। সেখান থেকে তিনি দামেস্কে যান। সমকালীন শাসক তাঁকে দামেস্কের বিচারক নিযুক্ত করেন।
অতঃপর তাঁকে কায়রোর বিচারক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৭১২ হিজরিতে তিনি কায়রোতেই ইন্তেকাল করেন। তাঁর পিতা শায়খ আহমদ (রহ.) জামে আল হাকেমের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান এবং সেখানে তিনি শাসক পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করতেন। শায়খ আহমদ (রহ.) ৭৪১ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।
মারিয়াম বিনতে আহমদ (রহ.)-এর ভাই শায়খ শামসুদ্দিন মুহাম্মদ (রহ.)-ও একজন স্বনামখ্যাত আলেম ছিলেন। তিনি জামে শায়খুনের খতিব এবং জামে আল জাদিদের শায়খ (শিক্ষা বিভাগের প্রধান) ছিলেন। তিনি ৮০৫ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।
মারিয়াম বিনতে আহমদ (রহ.) ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও মেধাবী। ধর্মীয় জ্ঞানের প্রতি তাঁর পিপাসা ছিল সীমাহীন। ইলমে হাদিসের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ মনোযোগ ও আকর্ষণ। নিজের অদম্য স্পৃহা ও পারিবারিক পৃষ্ঠপোষকতা তাঁর জ্ঞানার্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নিরবচ্ছিন্ন সাধনা তাঁকে হাদিসশাস্ত্রে বিশেষ পাণ্ডিত্য এনে দেয়। সমকালীন বড় বড় মুহাদ্দিসের কাছ থেকে তিনি হাদিসের সনদ লাভ করেন। যেমন—শায়খ আবুল আব্বাস আহমদ বিন মুহাম্মদ আজরায়ি (রহ.)। তিনি শায়খ আলওয়ানি (রহ.) ও শায়খ দাবুসি (রহ.)-কে হাদিস শ্রবণকারীদের মধ্যে সর্বশেষ হাদিস বর্ণনাকারী মুহাদ্দিস বলেছেন। আল্লামা মিকরিজি (রহ.) ‘আল উকুদ’ গ্রন্থে লিখেছেন, মারিয়াম বিনতে আহমদ (রহ.) তাঁর বেশির ভাগ হাদিসের শিক্ষকের থেকে সর্বশেষ হাদিস বর্ণনাকারী ছিলেন।
শিক্ষাজীবন সমাপনের পর তিনি হাদিসের পাঠদানে আত্মনিয়োগ করেন। ইসলামের ইতিহাসের বিখ্যাত বহু মনীষী তাঁর কাছ থেকে হাদিস শ্রবণ করেন। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরো কয়েকজন হলেন সিরাজুদ্দিন আবদুল লতিফ বিন মুহাম্মদ, মুহাম্মদ বিন আহমদ আল ফাসি, শামসুদ্দিন আহমদ বিন আবদুল্লাহ, যিনি ইবনু নাসিরুদ্দিন নামে পরিচিত, উবাদা বিন আলী আল জুরজারি, আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ বিন আলী কুরাইসি মাক্কি (রহ.) প্রমুখ।
ইমাম সাখাভি (রহ.) লেখেন, তাঁর শিক্ষক হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) মারিয়াম বিনতে আহমদ (রহ.) থেকে বহুসংখ্যক হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং নিজ মুজামে স্থান দিয়েছেন। মারিয়াম বিনতে আহমদ (রহ.) সম্পর্কে হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) লেখেন, ‘তিনি আলওয়ানি, দাবুসি, কুতুল হালবি, নাসিরুদ্দিন বিন সামউন (রহ.)-সহ বহু মুহাদ্দিসের কাছ থেকে হাদিস শ্রবণ করেছেন। শায়খ তকিউদ্দিন বিন সায়েগ (রহ.)-সহ মিসর, হিজাজ ও দামেস্কের একাধিক নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস তাঁকে হাদিসের অনুমতি দিয়েছেন।’
ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) তাঁর ‘আম্বাউল গুমার’ বইয়ে লেখেন, নিশ্চয়ই তিনি তাঁর (মারিয়াম বিনতে আহমদ) কাছে তাঁর শ্রবণকৃত ও অনুমতিপ্রাপ্ত বহু হাদিস পাঠ করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে শায়খ মারিয়াম বিনতে আহমদ (রহ.) অত্যন্ত বিনয়ী, আল্লাহভীরু ও জ্ঞানপ্রেমী ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। আল্লামা ফাসি তাঁর সনদে মারিয়াম বিনতে আহমদ (রহ.)-কে উম্মে ঈসা উপনামে উল্লেখ করেছেন, যা থেকে ধারণা করা যায়, তাঁর ঈসা নামে একটি ছেলে ছিল।
তিনি ৮০৫ হিজরিতে ৮৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। জন্মনগরী কায়রোতে তাঁর মৃত্যু হয় এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) তাঁর সংকলিত এক খণ্ডের একটি মুজাম বর্ণনা করেছেন।
সূত্র : আল মাজমা : ২/ ৫৬১; আল আ’লাম লিল-জারকালি : ৭/২১০; আল মুয়াল্লাফাতু মিনাননিসায়ি ওয়া মুয়াল্লাফাতিহিন্না, পৃষ্ঠা-৯৩
বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ