ওমর (রা.) ছিলেন মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা। উম্মতের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম তাঁকেই ‘আমিরুল মুমিনিন’ তথা মুমিনদের নেতা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তাঁর অতুলনীয় সাহস এবং সীমাহীন বীরত্বের কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে তাঁর নাম রাখেন ‘আবু হাফস’ তথা সিংহের পিতা। এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই যে ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর পর তিনিই মুসলিম উম্মাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।
মুসলিম জাহানের এই মহান খলিফা মোট ১০ বছর পাঁচ মাস ২১ দিন খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর খিলাফতকালেই সর্বাধিক অঞ্চল মুসলমানদের শাসনের অধীনে এসেছিল, যার আয়তন ছিল ২৩ লাখ বর্গমাইলেরও বেশি, যা ছিল সেই সময় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য। এ কারণেই তাঁকে বলা হতো অর্ধজাহানের খলিফা। (ইসলামের ইতিহাস, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৫৩)
ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে তাঁর নির্দেশনায় যেসব দেশ বিজিত হয় তার অন্যতম নিল নদের দেশ মিসর।
মিসর বিজয়ের ইতিহাসে কালের সাক্ষী হয়ে আছে যে ঘটনাগুলো, তার অন্যতম হলো নিলবধূয়া আখ্যান, যা ওমর (রা.)-এর খিলাফত পরিচালনার বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার উজ্জ্বল প্রমাণ বহন করে।
ওমর (রা.)-এর নির্দেশে মিসর বিজয়ের নেতৃত্ব দেন বিখ্যাত বীর সিপাহসালার আমর ইবনুল আস (রা.)। বিজয়ের পর খলিফার পরামর্শে তিনি নিল নদের পূর্ব তীরে নতুন এক নগরীর ভিত্তি স্থাপন করেন, যার নাম দেন ফুসতাত নগরী।
নগরীর নকশা প্রস্তুত, প্রতিটি গোত্রের জন্য পৃথক মহল্লা তৈরি, নগরীর কেন্দ্রস্থলে বিশালায়তন একটি দৃষ্টিনন্দন মসজিদ নির্মাণসহ বিজিত অঞ্চলের মুসলমানদের সার্বিক পর্যবেক্ষণের জন্য মিসরেই অবস্থান করছিলেন আমর ইবনুল আস (রা.)।
সব কাজ সুন্দরভাবেই এগোচ্ছিল। একদিনের ঘটনা। হঠাৎ কিবতি গোত্রের এক প্রতিনিধিদল আমর ইবনুল আস (রা.)-এর দরবারে উপস্থিত হলো এবং ‘নিলবধূয়া উৎসব’ উদযাপনের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করল।
নিলবধূয়া উৎসব কী?
প্রাচীনকাল থেকেই নিল নদের দেশ মিসরে একটি প্রথা চলে আসছিল—তারা প্রতিবছর ‘বুনা’ মাসের ১২ তারিখে (বুনা কিবতিদের একটি মাসের নাম) মিসরের সবচেয়ে সুন্দরী রূপসী কুমারী এক মেয়েকে নববধূর সাজে সাজাত এবং উৎসর্গের জন্য তাকে নিল নদে নিক্ষেপ করত।
মিসরীয়রা নিল নদকে দেবতা জ্ঞান করত। তাদের ধারণা ছিল, বছরে একবার নিল নদের জন্য সুন্দরী কুমারী মেয়ে উৎসর্গ না করলে দেবতা অসন্তুষ্ট হবেন এবং তাদের পানি দেবেন না।
আমর ইবনুল আস (রা.) তাদের কথায় অবাক হলেন। তার চেয়েও বেশি দুঃখ পেলেন এবং স্পষ্ট ভাষায় কিবতি গোত্রের লোকদের বলে দিলেন, ‘ইসলাম এই সব কুসংস্কারকে মোটেও সমর্থন করে না। সব কুসংস্কার নির্মূল করতেই ইসলামের আগমন। সুতরাং একটি মুসলিম জনপদে অন্যায়ভাবে কুমারী হত্যা আর উৎসর্গের নামে কুসংস্কার প্রথা কখনোই জারি হতে দেওয়া হবে না।’
আমর ইবনুল আস (রা.)-এর কথায় কিবতিরা খুবই মর্মাহত হলো এবং দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে নিজ গন্তব্যে ফিরে গেল।
ঘটনাক্রমে সত্যি সত্যি সেবার আর নিল নদে পানি এলো না। শুরু হলো আলোচনা-সমালোচনা। মিসরীয়দের একটা অংশ ছিল কৃষিজীবী। নিল নদের পানিতে তারা চাষাবাদ করত। পানি না থাকায় তারা পড়ল চরম বিপাকে। তাই কৃষকদের কেউ কেউ দেশ ছাড়ার ইচ্ছা পর্যন্ত করে ফেলল।
অবস্থা বেগতিক দেখে আমর ইবনুল আস (রা.) পুরো ঘটনা লিখে দূত মারফত পত্র পাঠালেন আমিরুল মুমিনিন ওমর (রা.)-এর কাছে এবং দ্রুত তাঁর পরামর্শ প্রার্থনা করলেন।
পুরো চিঠি পড়ে ওমর (রা.) জবাবে আমর ইবনুল আস (রা.)-কে লিখে পাঠালেন, ‘আপনি কিবতিদের যা বলেছেন, যথার্থ বলেছেন। আমি একটি চিরকুট পাঠালাম নিল নদের নামে। এটি নিল নদে নিক্ষেপ করবেন।’
আদেশ মোতাবেক চিরকুটটি নিল নদে নিক্ষেপ করা হলো। আল্লাহর কী মেহেরবানি, ওই বছরই নিল নদে পানি চলে এলো এবং এই পরিমাণ পানি এলো, যা নিল নদে এর আগে কখনো আসেনি।
নিল নদকে কী লিখেছিলেন ওমর (রা.)?
তিনি নিল নদকে লিখেছিলেন—
‘আল্লাহর বান্দা ও মুসলিমদের নেতা ওমরের পক্ষ থেকে মিসরের নিলের প্রতি—হে নিল! তুমি যদি নিজ ক্ষমতায় প্রবাহিত হও, তাহলে ঠিক আছে, আর প্রবাহিত হয়ো না। কিন্তু তোমার প্রবাহের উৎস যদি হয়ে থাকে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলার হাতে, তাহলে আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন তোমাকে প্রবাহিত করে দেন।’ (আশহারু মাশাহিরে ইসলাম, ৩য় খণ্ড; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০০; খেলাফতে রাশেদা, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৬৫)
লেখক : শিক্ষক, মাদরাসায়ে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ (সা.), সখীপুর, টাঙ্গাইল