সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

শোক নয়, কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর দিন

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

শোক নয়, কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর দিন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। ভোর ৫টার আগেই আমার টেলিফোন বেজে উঠল। ওদিক থেকে যিনি ফোন করেছিলেন তার নাম শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন তিনি ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব। উত্তেজিত গলায় বললেন, খবর পেয়েছেন? আমি বললাম না তো। কী খবর? বললেন মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। শুধু মুজিব নয়, তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। ওর আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও হামলা চালিয়েছে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী। ঢাকাসহ সমস্ত রেডিও স্টেশন তারা দখল করে নিয়েছে। রেডিও থেকে ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম নেতা মেজর ডালিম বারবার ঘোষণা করছেন, আর জয় বাংলা নয় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ স্লোগান। তখন টেলিভিশন ছিল না। আকাশবাণীর মাধ্যমে কলকাতাবাসীও জেনে গেছে, মুজিব আর নেই। ক্ষমতা দখল করেছে সেনাবাহিনী। রাষ্ট্রপতি হিসেবে একদা মুজিব ঘনিষ্ঠ খন্দকার মোশতাক আহমেদকে নিয়োগ করা হয়েছে। গোটা বাংলাদেশ স্তব্ধ। এপার বাংলায় শোকের ছায়া।

সকালেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। রেডিওর খবর শুনে সে সময় হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন। সবাই জানার চেষ্টা করছেন, খবরটা কি ঠিক, লোকের ভিড় তখন মধ্য কলকাতার সুন্দরী মোহন এভিনিউতে। যে বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথম সারির আওয়ামী লীগ নেতারা ৯ মাস ধরে ছিলেন, যে বাড়ি থেকে তারা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন, তার সামনে তখন কয়েক হাজার লোক। ঢাকা রেডিও থেকে জিয়া ঘোষণা করছেন, আমরা নতুন সরকার তৈরি করেছি। সবাইকে তিনি এই সরকারকে সমর্থন করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। ভয়ঙ্কর খবর। যেন বিশ্বাস করতেই ইচ্ছা করছিল না। এখান থেকে ঢাকায় ফোন করা যাচ্ছিল না। জিয়া-খন্দকার জুটি টেলিফোন ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন। দুপুরের দিকে ফোন করলাম শরদিন্দু বাবুকে। তিনি বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার। ইতিমধ্যে ঢাকা রেডিও থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, ওয়াশিংটন, বেইজিং, জেদ্দা এবং পাকিস্তান নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেন সেদিন কলকাতায় ছিলেন। ওই ঘটনার দিন রাতে ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিক্রিয়া দুই বছর পর ’৭৭ সালের এপ্রিল মাসে রায়বেরিলিতে শুনেছি ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র সঞ্জয় গান্ধী ও তার স্ত্রী মানেকা গান্ধীর মুখে। রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ ইন্দিরা খবরটি পান। পেয়ে তিনি একদম ভেঙে পড়েন। চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে থাকেন। সঞ্জয় বলেছিলেন, মা তখন ভাইহারা দিদির মতো হাউমাউ করে কাঁদছেন। তার ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ানকে ডেকে বললেন, এখনই ব্রেজনেভকে ধর। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভকে তিনি সব কথা খুলে বললেন। একই সঙ্গে ডাকলেন মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠক। ডেকে পাঠালেন ১৯৭১-এর যুদ্ধের নেতা ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশকেও। দীর্ঘ সময় আলোচনার মধ্যে দিল্লিতে ভোর হয়ে গেছে। তিনি তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বনে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে নির্দেশ দিলেন, বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা হাসিনা ও রেহানা এবং আরও কয়েকজন রয়েছেন, তাদের এখনই হোটেল থেকে আপনার বাড়িতে নিয়ে যান। দরকার হলে জার্মান সরকারের সাহায্য নিন। আমিও ওদের সঙ্গে কথা  বলছি। ইন্দিরা গান্ধী এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে ভালো করে কথা পর্যন্ত বলতে পারছিলেন না। হঠাৎ তিনি ধাওয়ানকে বললেন, প্রণবকে ডাক। অপর বাঙালি রাষ্ট্রমন্ত্রী দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় সেদিন দিল্লিতে ছিলেন না। ছিলেন না সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, বরকত গণি খান চৌধুরীর মতো নেতারাও। তাই প্রণব মুখার্জির ডাক পড়েছিল। প্রণব বাবু ২নং সফদরজং রোডের বাড়িতে এলে ইন্দিরা গান্ধী তাকে বলেন, ধাওয়ান সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। তুমি এখনই এয়ারফোর্সের বিমান নিয়ে জার্মানি চলে যাও। হাসিনা-রেহানা ও তাদের বাচ্চাদের এখানে নিয়ে এস। ওরা এলে আমি দেখা করব।

১৯৬৯ সালে প্রণব মুখার্জি ‘বাংলা কংগ্রেস’ নামে একটি আঞ্চলিক দলের সদস্য হিসেবে রাজ্যসভায় প্রথম যান। ১৯৭২ সালে তার একটি বক্তৃতা শুনে সবাই প্রশংসা করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনীর যে নেতারা কলকাতায় ছিলেন, তাদের সঙ্গে প্রণব বাবুর কোনো পরিচয় ছিল না। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের প্রবীণ নেতারা এখনো জিজ্ঞেস করেন, যুদ্ধের সময় ওনাকে দেখিনি কেন? ১৯৭৫ থেকে আটের দশকের গোড়ায় প্রণব বাবু এবং তার প্রয়াত স্ত্রীর সঙ্গে হাসিনা-রেহানাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। প্রণব মুখার্জির অসাধারণ বাগ্মিতার কারণে ধীরে ধীরে তিনি ওপরে উঠতে থাকেন। আজ তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি। তার স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর। হাসিনার পরিবারের সঙ্গে সে সময় প্রণব বাবুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়।

মুজিব হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধী দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। স্বীকৃতি কীভাবে এসেছিল, সে কথা আমি আগে কখনো লিখিনি। ১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে আমি কন্টিনেন্টাল হোটেলে ছিলাম। আমার কাজ ছিল লবিতে বসে বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে আলাপ করা এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের মতামত নেওয়া। হঠাৎ আমার সঙ্গে দেখা হলো পূর্ব পাকিস্তানের নিযুক্ত নেপালের উপ-রাষ্ট্রদূত মাধব রিমলের। নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বললাম। বিশুদ্ধ বাংলায় বললেন, আমি সিটি কলেজ এবং ল’ কলেজে পড়েছি। বাংলা ভালোই জানি। বললেন, খবর চাই তো? দুটোর সময় আমার ধানমন্ডি রোডের বাড়িতে আসুন। সেখানে তিনি ঢাকায় নিযুক্ত কনসাল জেনারেল ও উপ-হাইকমিশনারদের বৈঠক ডেকেছিলেন। যেহেতু তিনি কনস্যুলার ক্লাবের ডিন, তাই তিনি সমস্ত দেশের কূটনীতিকদের ডেকেছেন। তার বাড়িতে ঢুকে দেখি প্রচুর বিদেশি গাড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যে একেক করে সবাই বেরিয়ে গেলেন। আমাকে ওখানে দেখে মাধব রিমল বললেন, লিখে নিন— আমাদের আজ সিদ্ধান্ত হয়েছে, বর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে যে সরকার বাংলাদেশে আছে সে সরকারই আসল সরকার। সুতরাং নিজ নিজ সরকারকে অনুরোধ করুন, এই সরকারকেই কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিতে। তিনি আরও বলেন, বৈঠকে চীন ও আমেরিকার কনসাল জেনারেলরা ছিলেন না। আমি এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে সেখানেও চিঠি পাঠাচ্ছি। অবশ্য ওই দুটি দেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। তাই তাদের না আসাটা স্বাভাবিক।

তিনি আরও বললেন ভারত, নেপাল ও ভুটান এই সরকারকে আগেই স্বীকৃতি দিয়েছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেখলাম, জাপান, জার্মান, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের অন্তত ২৫-৩০টি দেশ নজরুল-তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। ঢাকায় উপস্থিত ওইসব দেশের কনসালরা তখনকার বিদেশমন্ত্রী সিলেটের আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে দেখা করে ওই স্বীকৃতির কথা জানিয়ে আসেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছানোর আগেই বহু দেশের স্বীকৃতি এসে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং জাপান থেকেও স্বীকৃতি পায় নতুন সরকার। জাপান তাদের কনস্যুলার দফতরকে দূতাবাস করে দেয়। প্রথম অ্যাম্বাসেডর হয়ে আসেন ইয়ামাদা। সেদিন থেকে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের পুনর্গঠনের জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে আসছিল। অথচ সেই জাপানি নাগরিকদের ওপরই সম্প্রতি সন্ত্রাসবাদীরা হামলা চালিয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে যে উন্নয়ন চলছে তার গতি স্তব্ধ করতেই কী তারা হামলা চালিয়েছিল?

কেন ১৯৭৫-এর ১৪-১৫ আগস্ট মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু তার পরিবারকে হত্যা করেছিল। তার ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় ধৃত সন্ত্রাসবাদীদের মুখে। ’৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের জন্ম হয়। আর ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়েছিল। তাই তারা এই সময়টাই বেছে নিয়েছিল। গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস দমনে যে পরিশ্রম করছেন তা রীতিমতো শিক্ষণীয়। আজকের দিনটি শুধু বাংলাদেশের কালদিবস নয়। পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশগুলোর প্রধানের এই দিনটি কালো দিবস হিসেবে পালন করা উচিত। পৃথিবীর জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি বাঙালি আছেন নানা প্রান্তে। হাসিনা সরকার যেভাবে জাতিসংঘে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায় করেছেন তেমনই এ দিনটিকে কালদিবস হিসেবে ঘোষণা করলে গোটা বাঙালি জাতি খুশি হবে।

এপার বাংলার বাঙালি যারা ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছাকে পূরণ করার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেছিলেন, তারা প্রশ্ন তুলছেন বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রকারীরা আবার কী করে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারল? এই দিনটি শুধু শোক প্রকাশের নয় কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়ানোর দিন। ধর্মের নামে নজরুলের ভাষায়, দুই বাংলায় বজ্জাতি বন্ধ করতে হবে। ভোটের নামে টাকার খেলা রক্তের খেলা বন্ধ করতে হবে। এই দিনে সমস্ত বাঙালি শপথ নিক, আর খুন নয়, রক্ত নয়, বাংলাদেশকে বাঙালির দেশ বলে সবার উচিত হবে একই সুরে কথা বলা। বাংলাদেশে কিছু ঘটলে, এপারেও তার প্রতিক্রিয়া হয়। বাংলাদেশ গোটা জাতির পক্ষে একটা গর্ব। এদিন সেই শপথই নিতে হবে। যাতে বাংলাদেশে আবার সেই কাল দিন ফিরে না আসে।

লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর