২৮ জুলাই, ২০১৬ ১৬:২৮

মহাশ্বেতা দেবী আর নেই

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

মহাশ্বেতা দেবী আর নেই

চলে গেলেন দুই বাংলার অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী। বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টা  ১৬ মিনিটে দক্ষিণ কলকাতার বেলভিউ নার্সিং হোমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। 

বার্ধক্যজনিত একাধিক সমস্যা নিয়ে গত ২২ জুন বেলভিউ নার্সিং হোমে ভর্তি হন তিনি। সেই থেকেই গত দেড় মাস ধরে ওই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। শারীরিক অবস্থা অবনতি হওয়ায় তাঁকে ভেন্টিলেটরেও স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন তিনি। শনিবার রাতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হন মহাশ্বেতা দেবী। ফলে তাঁর শারীরিক অবস্থা ফের সঙ্কটজনক হয়ে পড়ে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে কিডনি ঠিকমতো কাজ করছিল না। সঙ্গে ছিল শ্বাসকষ্ট, রক্তে সংক্রমণ। এরই মধ্যে নিয়মিত ডায়ালিসিসও নিতে হচ্ছিল তাঁকে। কিন্তু এরই মধ্যে এদিন বিকালে সবাইকে ছেড়ে পরলোকে পাড়ি দেন তিনি। 

হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর প্রকাশ্যে আসতেই লেখিকার শারীরিক অবস্থা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তাঁর স্বজন, পরিচিত ব্যক্তি, ও বন্ধুবান্ধবরা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ও নিয়তিম তাঁর স্বাস্থ্যের খোঁজখবর রাখছিলেন, যোগাযোগ রাখছিলেন তাঁর চিকিৎসকদের সঙ্গেও। মহাশ্বেতা দেবীকে দেখতে কয়েকদিন আগেও হাসপাতালে যান মুখ্যমন্ত্রী। 

এদিকে, তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বাংলা লেখক সমাজে। শোক প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। এদিন দিল্লি থেকে মমতা জানান, ‘বাংলা সাহিত্যিক জগতে এক বড় ক্ষতি হয়ে গেল। তিনি বলেন, ‘এক মহান সাহিত্যিককে হারালো দেশ। বাংলা হারালো মা’কে। আমি আমার অভিভাবককে হারালাম। তাঁর আত্মাার শান্তি কামনা করি’। এদিকে দিল্লি সফর কাটছাঁট করে আজই কলকাতায় ফিরছেন মুখ্যমন্ত্রী।

মহাশ্বেতা দেবীর প্রয়াণের খবর শুনেই হাসপাতালে ছুটে যান কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, গায়ক মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন প্রমুখ।

১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের ঢাকার এক শিক্ষিত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই বিশিষ্ট লেখিকা-সাহিত্যিক-সমাজসেবী। বাবা মণীশ ঘটক ছিলেন কল্লোল সেন যুগের একজন বিশিষ্ট কবি এবং সাহিত্যিক। তাঁর কাকা ঋত্বিক ঘটক ছিলেন বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক। মা ধারিত্রী দেবীও একজন প্রসিদ্ধ লেখিকা ও সমাজসেবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

ঢাকায় স্কুল জীবন শেষ করেন তিনি এরপর দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন মহাশ্বেতা দেবী। এপারে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধের শান্তি নিকতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী নিয়ে স্নাতক হন, এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর লাভ করেন তিনি। পড়াশোনার পাঠ শেষ করে বিশিষ্ট নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন মহাশ্বেতা দেবী। কিন্তু সেই বিয়ে বেশিদিন টেকেনি। ১৯৫৯ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় তাঁদের। তাঁর একমাত্র ছেলে নবারুণ ভট্টাচার্যও বাংলা সাহিত্যের একজন সুপ্রসিদ্ধ সাহিত্যিক ছিলেন। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে তিনিও মারা যান।

১৯৬৪ সালে বিজয়গড় কলেজ শিক্ষকতার মধ্যে দিয়েই তাঁর চাকরীজীবন শুরু। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতা ও সৃষ্টিমূলক লেখালেখির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৫ সালে হাজার চুরাশির মা, ১৯৭৭ সালে অরণ্যের অধিকার, অগ্নিগর্ভ (১৯৭৮), তিতুমীর, রুদালি, ছোটি মুন্ডা ইভাম তার তীর। তাঁর লেখা উপন্যাসকে নির্ভর করে ১৯৬৮ সালে নির্মিত হয়েছিল সংঘর্ষ, রুদালি (১৯৯৩), হাজার চুরাশির মা (১৯৯৮), মাটি মা (২০০৬), গঙ্গোর (২০১০)।

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের ‘লোধা’ ও ‘সবর’ উপজাতি স¤প্রদায় ভুক্ত মানুষের পাশাপাশি রাজ্যের নিপীড়িত, পিছিয়ে পড়া নারীদের নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। বিহার, ছত্রিশগড় এবং মধ্যপ্রদেশের উপজাতি শ্রেণির মানুষদের জীবন যুদ্ধেও সামিল হয়েছিলেন তিনি। মহাশ্বেতা দেবী বিভিন্ন উপজাতির লড়াইয়ে নিজেকে বহুবছর ধরেই জড়িয়ে রেখেছেন। তাঁর গল্প-উপন্যাসেও উঠে এসেছে উপজাতি ও তফশিলি জাতির বঞ্চনা ও সমস্যার কথা। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ বাম জমানার অবসান ঘটিয়ে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পিছনেও যথেষ্ট অবদান ছিল এই সাহিত্যিকের। সিঙ্গর থেকে নন্দীগ্রাম প্রতিটি আন্দোলনেই তৃণমূল সরকারের পাশে ছিলেন তিনি। তবে পরিবর্তন আনতে বদ্ধপরিকর হলেও কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে থাকতে রাজি হননি তিনি।

সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ হিসেবে ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৯ সালে তিনি পান সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার। ১৯৮৬ সালে ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভুষিত হন, ১৯৯৬ সালে পান জ্ঞানপীঠ, ১৯৯৭ সালে রমণ ম্যাগসাইসাই পুরস্কার, ২০০৬ সালে ভারত সরকারের পদ্মবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি, ২০১০ সালে যশবন্তরাও চ্যবন জাতীয় পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে ২০১১ সালে পান বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার।

 

বিডি-প্রতিদিন/ ২৮ জুলাই, ২০১৬/ আফরোজ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর