শিরোনাম
১৮ আগস্ট, ২০১৭ ১১:৫৭

কলকাতা ছেড়ে চেন্নাই-বেঙ্গালুরু-দিল্লিমুখী হচ্ছে বাংলাদেশি রোগীরা

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

কলকাতা ছেড়ে চেন্নাই-বেঙ্গালুরু-দিল্লিমুখী হচ্ছে বাংলাদেশি রোগীরা

চিকিৎসায় গাফিলতি, অহেতুক বিল বাড়িয়ে দেখানো, অকারণে ব্যয়বহুল পরীক্ষা, এক ওষুধ বার বার দেওয়া, অর্থ পরিশোধ না করলে লাশ আটকে রাখা- এমন একের পর এক অভিযোগ উঠে আসছে কলকাতা শহরের নামি বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিং হোমগুলোর বিরুদ্ধে।

পশ্চিমবঙ্গের এই হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা করতে আসা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিদেশি বিশেষ করে বাংলাদেশি রোগীদেরও প্রতিনিয়ত এই হয়রানির শিকার হতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়েছে রোগীর সংখ্যায়। হাসপাতালগুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশি রোগীরা। 

গত কয়েক মাসে কলকাতার ছয়টি সেরা বেসরকারি হাসপাতালে বাংলাদেশ থেকে আসা রোগীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এর কয়েকটিতে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা কমেছে ১৫ শতাংশ। 

গত কয়েক দশক ধরেই শহরের ইএমবাইপাশ সংলগ্ন বেশ কয়েকটি হাসপাতালগুলির ব্যবসায়িক দিকটি নির্ভর ছিল এই বাংলাদেশি রোগীর ওপর। বাংলাদেশ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ছাড়াও ভারতের অন্য রাজ্য থেকেও রোগীর সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে এই হাসপাতালগুলিতে। 

কিন্তু ‘সেবার তুলনায় ব্যবসায়িক স্বার্থ’ বেশি দেখা হচ্ছে- হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ওঠার পর থেকেই অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই এই অভিযোগের বিষয়টি সামনে এনে তাদের হুঁশিয়ারি দেন রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তিনি জানান যে 'সেবা করুন, সেবা কখনও বিক্রি হয় না। ইট-কাঠের ব্যবসা চালানো আর মানুষের জীবন বাঁচানো এক জিনিস নয়, দুইটির মধ্যে পার্থক্য আছে। একশত শতাংশ লাভ করা যাবে না।'

হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলিকে কড়া নজরদারির মধ্যে রাখতে ‘হেলথ রেগুলেটারি কমিশন’ও গঠন করে রাজ্য সরকার। তবে এরপরও যে অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে তা নয়।

কলকাতা শহরের নামী একটি হাসপাতাল হল এএমআরআই বা আমরি। ঢাকুরিয়া, মুকুন্দপুর ও সল্টলেক-আমরি’র এই তিনটি কেন্দ্রেই প্রতিমাসে গড়ে ২৫০০ বাংলাদেশি রোগী আসে। কিন্তু গত মার্চ মাস থেকে এই সংখ্যাটা প্রায় ১৫ শতাংশ কমেছে। আমরি'র চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) রূপ বড়ুয়া’র অভিমত, গত ফেব্রুয়ারিতে আমরিতে রোগীর পরিবারের তরফে হামলার পরই কলকাতার হাসপাতালগুলির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ওই ঘটনার পরই বেসরকারি হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে রোগীদের লুঠ করার অভিযোগ ওঠার পরই বিষয়টিতে রাশ টানেন মুখ্যমন্ত্রী।

রূপক বড়ুয়া জানান, এরপর থেকেই কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা কমতে থাকে। কলকাতার পরিবর্তে তাদের এখন প্রথম পছন্দ দিল্লি এবং দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি। স্বাস্থ্য পরিসেবাটি মূলত বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু একবার যদি সেই বিশ্বাসে ভাঙন ধরে তবে এই শিল্পের পক্ষে তা বিপজ্জনক।  

কলকাতার ইএমবাইপাশের কাছেই বেসরকারি হাসপাতাল রুবি জেনারেল হাসপাতাল। প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৪৫০ বাংলাদেশি রোগী আসে এখানে। এরমধ্যে ইনডোর পেসেন্ট'র সংখ্যা ৩০ জনের মতো। গত জুনে সেই সংখ্যাটা নেমে ২০'এ দাঁড়ায়। 

রুবির জেনারেল ম্যানেজার (অ্যাডমিন) শুভাশিস চক্রবর্তী জানান, গত মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত রোগী ভর্তি (অন্ত:বিভাগ) এবং বহি:বিভাগে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা অনেকটা কমেছে। জুলাইতে সংখ্যাটা একটু বাড়লেও ভারতের অন্য শহরগুলিতে বাংলাদেশি রোগীদের চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোন ভাটা পড়েনি।

তিনি আরও জানান, গত ফেব্রুয়ারি মাসে বেসরকারি হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠার পর থেকে বাংলাদেশি রোগীরা এই পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছিলেন। এ বিষয়ে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সরব ছিলেন। তারা এখন খুবই সতর্ক, বিশেষ করে এখানকার হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে। হারানো ভাবমূর্তি উদ্ধার ও আস্থা যোগাতে না পারলে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা বাড়ানোর কোন সম্ভাবনা নেই। 

তবে বাংলাদেশি রোগীর হ্রাসের পিছনে ভিসা সমস্যাও কাজ করেছে বলে অভিমত শুভাশীষ চক্রবর্তীর। তিনি জানান, কলকাতার হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশি রোগীদের মেডিকেল ভিসা করাটা এখন বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা গেছে যে তারা মূলত ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে কলকাতায় বেড়াতে এসে চিকিৎসা করাতে বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু এখন তাদের আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রাখাটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেক্ষেত্রে করকাতার থেকে ভাবমূর্তি ভাল যেমন চেন্নাই, বেঙ্গালুরু এবং দিল্লি'র মতো শহরগুলিকে বেছে নিতে পারছে।

দক্ষিণ কলকাতার দুইটি বেসরকারি হাসপাতালেও বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা কমেছে। প্রতি মাসে গড়ে এই হাসপাতাল দুইটিতে যেখানে ৭০০ রোগী আসতো সেখানে গত পাঁচ মাসে কমেছে ৫ শতাংশ। 

তবে এতকিছুর মধ্যে কলকাতার কয়েকটি হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা অল্প হলেও বেড়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে একটি হল ইএম বাইপাশের ধারে অবস্থিত অ্যাপোলে গ্লেনিগেলস হাসপাতাল। এই হাসপাতালটিতে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার রোগী আসে। মুকুন্দপুরের রবীন্দ্রনাথ টেগোর ইন্টারন্যাশনাল ইন্সিটিউট অফ কার্ডিয়াক সায়েন্সেস (দেবি শেঠি বলে সর্বাধিক পরিচিত) হাসপাতালেও বাংলাদেশি ও ভারতের অন্য রাজ্যগুলিতে আসা রোগীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে খবর।    

বিডি প্রতিদিন/১৮ আগস্ট, ২০১৭/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর