১৯ মার্চ, ২০১৮ ২১:১২

বাদল ফারাজিকে মুক্ত করতে ইন্ডিয়া গেটে র‌্যালি

দীপক দেবনাথ, কলকাতা:

বাদল ফারাজিকে মুক্ত করতে ইন্ডিয়া গেটে র‌্যালি

গত দশ বছর ধরে দিল্লির তিহার জেলে (সংশোধনাগার) বন্দি বাংলাদেশের বাগেরহাটের বাসিন্দা বাদল ফরাজিকে মুক্তির দাবিতে দিল্লির রাজপথে শান্তিপূর্ণ জমায়েতে পা মেলালেন কয়েক হাজার মানুষ। 

রবিবার বিকাল ৪ টায় দিল্লির ইন্ডিয়া গেট’এ বাদল ফারাজির পাশে থাকার বার্তা দিতে হাজির হয়েছিলেন তারা। হাতে প্ল্যাকার্ড, পোস্টার নিয়ে এই জমায়েতে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ প্রত্যেকেই সামিল হন। যদিও সেই মিছিলে রাজনীতির কোন রঙ ছিল না।
 
ইন্ডিয়া গেটে এই জমায়েতের প্রধান উদ্যোক্তা সমাজসেবী ভারতের উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা রাহুল কাপুর। বাদলকে দ্রুত কারাগার মুক্ত করতে গত দুই বছর ধরে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন রাহুল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোশ্যাল ওয়ার্কে মার্স্টাস করা রাহুল সামাজিক কাজের জন্য ২০১৬ সাল থেকে তিহার জেলে যাতায়াত করছেন। 

কারাগারের বন্দীদের পুনর্বাসন, তাদের কাউন্সেলিং-এর কাজ করতে করতেই বাংলাদেশি নাগরিক বাদল ফারাজির সাথে পরিচয় হয় রাহুলের। বাদলের কথা শুনেই প্রচন্ড নাড়া দেয় রাহুলকে। রাহুল জানতে পারে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছে বাদলকে। বাদলের মুখ থেকে সবকিছু শুনে নতুন লড়াই শুরু হয় ভারতীয় সমাজসবী রাহুলের। দিল্লির কারাগার থেকে বাদলকে মুক্তি করতে, বাদলের ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দেশ ভুলে সম্মিলিত ভাবে অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর করার আর্জি জানান রাহুল। সাড়াও মেলে দারুণ। 

ইতিমধ্যেই ‘জাস্টিস ফর বাদল’-শীর্ষক ওই পিটিশনে বাদলের মুক্তি চেয়ে ২০০০ জনের বেশি মানুষ স্বাক্ষর করে ফেলেছেন। এর পাশাপাশি বাদলের মুক্তির বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের সাথে। 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও চিঠি লিখে বাদলের মুক্তির বিষয়টি তরান্বিত করতে উদ্যোগী হয়েছেন রাহুল। আর এরপর বাদলের মুক্তির ব্যাপারে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ইন্ডিয়া গেটে এই জমায়েতের আয়োজন। বাদলের পাশে দাঁড়াতে গত কয়েক দিন ধরেই ফেসবুক লাগাতার প্রচার চালিয়েছেন রাহুল।
 
তিনি জানিয়েছেন ভারতে ঘুরতে এসে পুলিশের হাতে তিনি আটক হন।এরপর এক খুনের ঘটনায় তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এখন তিনি ভারতে যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ কাটাচ্ছেন। কিন্তু যখন এই খুনের ঘটনা ঘটে বাদল তখন তাঁর নিজের দেশে ছিলেন।তাঁর মুক্তির ব্যাপারে আমি বাংলাদেশ হাইকমিশনে গিয়েছিলাম। আমি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে চিঠি লিখেছি। কিন্তু কোন সুরাহা হয় নি। তাই এই নতুন উদ্যোগ।
  
এদিকে ছেলে বাদলের মুক্তির পথ চেয়ে বসে আছেন তাঁর মা সরাফালি বেগম। দিল্লির তিহার জেল থেকে ছেলের দ্রুত মুক্তির জন্য ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, স্বরাষ্ট্ররমন্ত্রী রাজনাথ সিং, দেশটির সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও আর্জি জানিয়েছেন সরাফালি বেগম। ফেসবুকের মাধ্যমেই তিনি দুই দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আর্জি জানিয়ে আবেগঘন কন্ঠে বলেন ‘আমি সকলের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি যে, আমার ছেলে যাতে আমার বুকে ফিরে আসতে পারে। ছেলের শোকেই আমার স্বামী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আমিও অসুস্থ। আমি যাতে ছেলেকে শেষ দেখা দেখে মরতে পারি। আমার মা’ও অসুস্থ, তিনি শয্যাশায়ী। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। আজ আমি খুবই অসহায়, আমাদের দেখার কেউ নেই, দুই মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। এই অবস্থায় আমি কোন টাকা চাই না, আমি চাই আমার ছেলে যাতে আমার কাছে ফিরে আসে। আমি ভারতের সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই যে আপনারা সেই ব্যবস্থা করবেন’।

উল্লেখ্য তাজমহল দেখতেই ২০০৮ সালের ১৩ জুলাই ভারতে আসেন বাগেরহাটের মংলা বন্দরের কাছে ১৭ নম্বর ফারুকি রোডের টিএ ফারুক স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী বাদল। ওইদিন দুপুরে বেনাপোল অভিবাসন কার্যালয়ে সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করে ভারতের হরিদাসপুর সীমান্তে প্রবেশের পরই খুনের অপরাধে বিএসএফ বাদলকে আটক করে বলে অভিযোগ।
 
জানা যায় ২০০৮ সালে ৬ মে দিল্লির অমর কলোনিতে এক বৃদ্ধাকে খুনের অভিযোগে বাদল সিং নামে একটি ব্যক্তিকে খুঁজছিল পুলিশ। তাকে ধরতে সীমান্তেও সতর্ক করা হয়েছিল কিন্তু শুধুমাত্র দুই জনের নাম এক হওয়ার কারণেই বাংলাদেশি নাগরিক বাদল ফরাজি’কেই হাজতে ঢুকতে হয়। কিন্তু শুধুমাত্র হিন্দি বা ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে না পারার মাসুল গুনতে হয় বাদলকে। কারণ ভাষা সমস্যার কারণেই বাদল সেসময় বিএসএফ’এর কর্মকর্তাদের বোঝাতেই পারেনি যে খুনের অভিযোগ যে বাদলকে খোঁজা হচ্ছে তিনি সেই ব্যক্তি নন।
 
এরপর হরিদাসপুর থেকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে বাদল ফরাজিকে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লিতে। খুনের অভিযোগে ভারতীয় দন্ডবিধির ৩০২ নম্বর ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হয় বাদলের বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালের ৭ আগষ্ট বাদলকে দোষী সাব্যস্ত করে দিল্লির সাকেট আদালত। বাদলকে যাবজ্জীবন সাজা ঘোষনা করা হয়। 

পরবর্তীতে দিল্লি হাইকোর্টও নিম্ন আদালতের সেই রায় বহাল রাখে। পরে তার স্থান হয় দিল্লির তিহার জেলে। কিন্তু বিনা দোষে এই সাজা কোনভাবেই মেনে নেয় নি বাদল। দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহায়তায় হাইকোর্টের সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন বাদল। কিন্তু শীর্ষ আদালতও বাদলের আর্জি খারিজ করে দেয়। ফলে গত দশ বছরের বেশি সময় ধরে জেলের কুঠুরিতে কাটাতে হচ্ছে বাদল(২৮)-কে।
 
তবে গত এক দশক ধরে বাদলও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে সমস্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দিল্লিতে বৃদ্ধা খুনের সময় তিনি যে ভারতেই ছিলেন তাও জানিয়েছেন তিনি। তার কথা শুনে কারাগারের অন্য কয়েদিরা ও জেল কর্তৃপক্ষেরও বিশ্বাস বাদল মিথ্যা বলছেন না। কারাগার কর্তৃপক্ষও বাদলের সংযত ও ভাল ব্যাবহারের প্রশংসা করছে। 

গত এক দশক ধরে নিজেকে অনেকটাই বদলে ফেলেছেন বাদল। কারাগার থেকে পড়াশোনা করেই স্নাতক হন বাদল। কারাগার চত্ত্বরে থেকেই ইন্দিরা গান্ধী ওপেন ইউনির্ভাসিটি’থেকে প্রতিটি পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে কৃতকার্য হন বাদল। একটা সময় যে ভাষা সমস্যার কারণে তাকে এতবড় শাস্তি পেতে হয়েছিল বাদলকে, আজ তিনিই ইংরেজি বা হিন্দিতে অনর্গল কথা বলছেন। ইংরেজি ভাষা শিক্ষার সার্টিফিকেট কোর্সও করেছে সে।

বিডিপ্রতিদিন/ ১৯ মার্চ, ২০১৮/ ই জাহান

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর