৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১৫:২০

কলকাতার অনেক হোটেলেই ‘বিফ’ এখনও আবেগের জায়গা

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

কলকাতার অনেক হোটেলেই ‘বিফ’ এখনও আবেগের জায়গা

‘গোমাংস’কে ঘিরে কম বিতর্ক হয়নি ভারতে। এই বিতর্কের জেরে দেশটির অধিকাংশ হোটেলেই মেনু কার্ড থেকে উধাও হয়ে গেছে ‘বিফ’ শব্দটি। তবে ভিন্ন ছবি কলকাতায়। শহরের একাধিক হোটেল রয়েছে যেখানে কেবল এই ‘বিফ’ এর স্বাদ পেতেই দূরদুরান্ত থেকে ছুটে আসেন খাদ্যপ্রেমীরা।

কলকাতা শহরের ঐতিহাসিক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাড়াসহ পাশ্ববর্তী এলাকায় খাবারের দোকানগুলিতে ইংরেজি ও ভারতীয় খাবারের সংমিশ্রণে গরুর মাংসের নানা পদ সরবরাহ করা হয়ে চলেছে। কলকাতার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পাড়া বলতে বোঝায় মধ্য কলকাতার ‘বো ব্যারাক’ এলাকা। কলকাতার অতি প্রাচীন চাইনিজ রেস্তোরা ‘ওয়াল্ডডর্ফ’ এর সাবেক ম্যানেজার অ্যান্ড্রু লিপন জানান, ‘গোমাংস ছাড়া অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান খাবার ভাবাই যায় না। কারণ মাটন ও চিকেন সেই ফেভার দিতে পারবে না। মরিচের পানি দিয়ে জালফ্রেজি, স্টিক বা হুসেইনি কারি, বল কারি-এসবই গোমাংস দিয়ে তৈরি। আর এই ডিশগুলোর সাথেই আমি বড় হয়েছি।

কিন্তু সারা ভারত জুড়ে গোমাংস-কে কেন্দ্র করে যে রাজনীতি শুরু হয়েছে তা নিয়ে অ্যান্ড্রু যথেষ্টই হতাশ। বেশিরভাগ রাজ্যেই গরুর পাশাপাশি বলদ ও বাছুর জবাইয়ের ওপরও নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে। গরু জবাইয়ের অভিযোগে গণপিটুনিতে মানুষের মৃত্যুও অভিযোগও উঠেছে কিন্তু সব দেখে শুনেও প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে চলেছে। গরু জবাই নিয়ে আতঙ্ক এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে সম্প্রতি কেরালার ভয়াবহ বন্যার পিছনেও গরু জবাই দায়ী বলে অভিযোগ করেছেন বিজেপির নেতারা।

তবে কলকাতা এসব বিতর্ক থেকে অনেকটাই দূরে। এই শহরের খাদ্য সংস্কৃতি অনেকটাই সমৃদ্ধ, যার মধ্যে আবার বেশিরভাগ মানুষের পছন্দের তালিকায় আছে গোমাংস-কে ঘিরে এবং এই ইস্যুতে এখনও পর্যন্ত ভারতের অন্য শহরগুলির তুলনায় এই শহর অনেকটাই সুরক্ষিত।

মধ্য কলকাতার এন্টালি এলাকার রেস্তোরা ‘জ্যাম জ্যাম’। মটন বিরিয়ানির জন্য প্রসিদ্ধ এই খাবারের দোকানটিতে এখন শহরের সেরা ‘বিফ’এর নানা পদও পাওয়া যাচ্ছে। ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখেই গত মে মাসেই পার্ক সার্কাস এলাকায় নতুন আউটলেট খুলেছে ‘জ্যাম জ্যাম’।

এ ব্যাপারে ম্যানেজার শাহ বাবর জানান, আমরা আমাদের গ্রাহকদের সংখ্যা আরও বিস্তৃত করতে চেয়েছিলাম। অফিস যাত্রী থেকে শুরু করে পরিবার, নারীদেরও আমরা এখানে গ্রাহক হিসাবে পেয়েছি। যারা সাধারণত আমাদের এন্টালি শাখায় আসে না, তারাও নতুন শাখায় আসছে।

ভুনা ও স্বল্প মশলাযুক্ত বিফ বিরিয়ানি ছাড়াও জ্যাম জ্যাম-এ মশলাযুক্ত ঘোল (কলকাতায় মুসলিমদের বিয়েতে অতিথিদের পরিবেশন করা হয় এই পানীয়) দারুণ জনপ্রিয়।

রাস্তা পার করলেই ‘জ্যাম জ্যাম’ এর উল্টোদিকে রয়েছে ‘নাফিল’। পার্ক সার্কাস এলাকায় ‘বিফ’এর বিশ্বস্ত প্রাচীন খাবারের দোকান এটি। কর্মরত মানুষদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই খাবারের দোকানে এখন সমাজের সবস্তরের মানুষই আসেন।

সেখানকারই এক কর্মকর্তা আরিফ আলি জানান, আমাদের এখানে প্রত্যেকেই আসেন। রবিবারে মুসলিম ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে শুরু করে খ্রিষ্টান সকলেই..। পূজার সময় আমরা সারা রাত ধরেই দোকান খোলা রাখি।

কলকাতার রিপন স্ট্রিটের ‘বেঙ্গল হোটেল’ প্রতি শুক্রবার করে পাওয়া যায় বিফ খিচুড়ি। জুম্মা নামাজের পরই মুসলিমরা এখানে খাবারের জন্য ভিড় করে। এর মালিক মোহাম্মদ নিজামুদ্দিন দীপ্তকণ্ঠে জানান, আমরা মাত্র বড় এক কড়াই খিচুড়ি তৈরি করি এবং এক ঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ হয়ে যায়।

এই হোটেলের আরেকটি জনপ্রিয় খাবার হল ‘পাগলা ভুনা’ বা ‘ক্রেজি রোস্ট’। এই এলাকায় বাস করা অধিকাংশ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরাই এখানে এসে পাগলা ভুনা নিয়ে যায়।

দেড় শতাধিক বছরের পুরানো নিউমার্কেট থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে রয়েছে ‘কালমান’। ১৯৫০ শতকের কোন একটি সময়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে গড়ে উঠেছিল এই কোল্ড স্টোরেজটি, এটি এখন শহরের ল্যান্ডমার্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘কালমান’এর ম্যানেজার জয় ঘোষ জানান, শহরের ধর্মনিরপেক্ষতা বহন করে চলেছে এই রেস্তোরাঁটি। কলকাতা শহরে এটিই একমাত্র জায়গা যেখানে বিফ ও পর্ক-উভয়ই পাওয়া যায়। একটা সময় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান গ্রাহকই বেশি পেতাম কিন্তু শতকরা ২৫ ভাগ বাঙালি কাস্টমার আমাদের এখানে আসেন। তারা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করেন, এই ধরনের খাবার সম্পর্কে জানেন এবং তারপর এখানে খেতে আসেন।

কালামের জনপ্রিয় ডিশগুলো হল স্পাইসড, স্মোকড হাঙ্গেরিয়ান সসেজ কিন্তু তাদের সংরক্ষিত ‘অক্স টাঙ’ পদটিও অত্যন্ত জনপ্রিয় বলে জানিয়েছেন জয় ঘোষ।

ফ্রি স্কুল স্ট্রিটেই রয়েছে ‘মোকাম্বো’ নামে আরেকটি অভিজাত রেস্তোরাঁ। এখানকার এক কর্মী রজার মাক্কান জানান, বিফ স্টেক-ই হল তাদের বিক্রিত পণ্যের অন্যতম একটি। এটি একটি সুস্বাধু, তৈলাক্ত ও মশলাযুক্ত খাবার যেটি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের কাছে একটি সুপরিচিত খাবার হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে।
 
‘অলিপাব’ পার্কস্ট্রিটের এই রেস্তোরাঁটিতেও জনপ্রিয় খাবার হল বিফ স্টেক। স্কুলের পুরানো বন্ধুদের সাথে নিয়ে এখানে খেতে আসা রাহুল সাহা নামে এক যুবক জানালেন, আমরা যখনই এখানে আসি, আমাদের যেটা দরকার সেটা পেয়ে যাই। আমরা কেবল বিফ স্টেক-এর জন্যই অলিতে আসি।

গত এপ্রিলেই কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায় আত্মপ্রকাশ করেছে ‘শিম শিম’ নামে একটি তিব্বতি রেস্তোরাঁ। হোটেলের নারী মালিক ডোমা ওয়াং কালিম্পং’এর বাসিন্দা হলেও গত তিন দশক ধরে এই কলকাতা শহরেই বসবাস করছেন। তিনি জানান ‘আমার জন্মস্থান কালিম্পং’এ কিন্তু এখানে বিফ মোমো এবং বিফ থুকপাস-এই দুইটাই খুব মিস করি। কলকাতা এমন একটা জায়গা যেখানে মানুষ সত্যিই খেতে ভালবাসেন এবং তারা এব্যাপারে খুবই দুঃসাহসী। তাই নতুন কিছু জিনিস করার চেষ্টা করছি। আসলে কলকাতা খেতে ভালবাসে। তাই আপনি যদি নায্য দামে ভাল খাবার পরিবেশন করতে পারেন সেখানে কোন ভুল নেই।

তবে কলকাতা শহরে ‘বিফ’ এর কদর ও বিক্রি বাড়ার সাথে সাথেই মাংস নিয়ে রাজনীতিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। গরু খাওয়ার বিষয়টি নিয়ে যেভাবে রাজনীতিকরণ করা হচ্ছে তাতে শহরের সাথে ‘বিফ’এর সম্পর্কেরও পরিবর্তন হচ্ছে। আর এতেই উদ্বিগ্ন শহরের অধিকাংশ মানুষ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো মানুষ মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটছে। কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলির রোষানল যেহেতু গোমাংস’এর ওপর গিয়ে পড়ছে তাতে কিছু রেস্তোরা ‘বিফ’ পরিবেশন বন্ধ করে দিয়েছে নয়তো তাদের মেনু থেকে ‘বিফ’ শব্দটাই উঠিয়ে দিয়েছে এবং একমাত্র বিশেষ অনুরোধের পরই ‘বিফ’এর পদ পরিবেশন করা হচ্ছে সেখানে। কোন কোন রেস্তোরাঁ আবার সুকৌশল করে ‘বিফ’ এর বদলে ‘টেন্ডারলয়েন’ শব্দটি ব্যবহার করছেন, না হয় বলে দেওয়া হচ্ছে এটা পুরোপুরি মুসলিমদের জন্য। আসলে আশঙ্কা থেকেই ঘটছে এই ঘটনা। 

এক রেস্তোরাঁ মালিক বলেই দিলেন, আমরা কেউই জানি না যে কি ঘটনা ঘটতে চলেছে। তাই ‘মাংস’ শব্দটা ব্যবহার না করে ‘টেন্ডারলয়েন’ শব্দ ব্যবহার করছি। 

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর