৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ১৩:১৩

ফুটপাতে রাতভর অবস্থান মমতার, ভারতজুড়ে তোলপাড়

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

ফুটপাতে রাতভর অবস্থান মমতার, ভারতজুড়ে তোলপাড়

দ্বিতীয় দিনে পড়ল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ধরনা বা অবস্থান বিক্ষোভ। কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাড়িতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই’এর কর্মকর্তাদের অভিযানের প্রতিবাদেই রবিবার রাত থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগে ধরনা শুরু করেন মমতা ব্যনার্জি। প্রথমে কলকাতার ধর্মতলায় মেট্রো চ্যানেলে ফুটপাতে খোলা আকাশের নীচেই চেয়ার পেতে ধরনায় বসেন মমতা। সাথে ছিলেন কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, ইন্দ্রনীল সেন, লোকসভার সাংসদ সুব্রত বক্সি, রাজ্য পুলিশের ডিজি বীরেন্দ্র, রাজ্যের নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুরজিত সুর পুরকায়স্থ এমনকি রাজীব কুমার-ও। এরপর বাঁশ-তাবু দিয়ে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরির পর চেয়ার ছেড়ে ওই মঞ্চে শুরু হয় ধরনা। এসময় পালা করে মমতার সাথে ছিলেন রাজ্যের একাধিক মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক, দলের শীর্ষ নেতারা। সারা রাত ধরে মমতা কখনও মঞ্চের ওপরই পায়চারী করেছেন, আবার কখনও দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নেতাদের সাথে কথা বলে তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছেন, আবার কখনও নিজের দলের মন্ত্রী-নেতাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন বা পরবর্তী কৌশল ঠিক করতে বৈঠকও সেরেছেন।

মমতার অভিমত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সংবিধান রক্ষার দাবিতে তার এই ধরনা। রাজীব কুমারের বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তার এই ধরনা চলতেই থাকবে। এমনকি মোদি-অমিত শাহ-এর বিরুদ্ধে রাজ্যে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। মমতার ধরনা শুরু হওয়ার পরই দেশজুড়ে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনীতির পারদ। রাতেই কলকাতায় নিজাম প্যালেস, সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সেসহ কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তকারী সংস্থাগুলির কার্যালয়ের সামনে প্রহরার দায়িত্বে জন্য নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। অন্যদিকে সিবিআই অভিযানের প্রতিবাদে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সড়ক, রেল অবরোধে নামেন তৃণমূলী কর্মী-সমর্থকরা। সোমবার সকালেও একাধিক জায়গা সড়ক, রেল অবরোধের পাশপাশি প্রধানমন্ত্রীর কুশপুতুল পোড়ান হয়। 

এদিকে, সকাল হতেই মঞ্চ থেকে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মমতা। সপ্তাহের শুরুর প্রথম দিন পশ্চিমবঙ্গ সচিবালয় নবান্নের বদলে এই মঞ্চ থেকেই মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি। সর্বদা মোবাইল ঘেটে দেশ-বিদেশের পরিস্থিতির দিকেও নজর রাখছেন তিনি। এদিকে আজ রাজ্যের বাজেট ঘোষণা হবে। বাজেট পেশের আগে ক্যাবিনেট বৈঠক আবশ্যিক। সেক্ষেত্রে ধরনা মঞ্চের পাশেই নির্মিত একটি অস্থায়ী ঘরে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করবেন। 

এদিন সকালেও ধরনা মঞ্চ থেকেই বক্তব্য রাখতে গিয়ে কেন্দ্রকে আক্রমণ করে মমতা বলেন, ‘মোদি সরকার প্রতিহিংসামূলক আচরণ করছে। কৃষকদের ঘুম কেড়েছে মোদি সরকার। নোটবাতিলের ফলে কৃষকরা আজ ক্ষতিগ্রস্ত। আমাদের রাজ্য সরকারই কৃষকদের প্রতি সহানুভূতিশীল।’ 

গতকালের রাতের পর এদিন সকাল থেকেই বিভিন্ন সময় মমতার ধরনা মঞ্চে হাজির হন তৃণমূলের মন্ত্রী-নেতারা। মমমতাকে সমর্থন জানাতে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সমাজবাদী পার্টি নেতা কিরণময় নন্দ। মঞ্চে আসতে পারেন আপ নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল, আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদবদের মতো নেতারাও। তাছাড়াও দলনেত্রীর ধরনা মঞ্চে বসার খবর শুনে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলীয় কর্মী-সমর্থকরা ধরনা মঞ্চের সামনে মমতাকে দেখার জন্য ভিড় করতে শুরু করেন। 

দেশটির একাধিক রাজনীতিবিদ মমতার এই পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন। ট্যুইট করে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী জানান, ‘রাতে মমতা-দির সাথে কথা বলেছি। তাকে বলেছি আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাশে রয়েছি। মোদি ও বিজেপি-র দ্বারা ভারতের যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্মম হামলা চলছে, বাংলার ঘটনা তারই অংশ। সব বিরোধী একজোট হবে এবং এই স্বেচ্ছাচারী শক্তিকে পরাস্ত করবে।’ 

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টি (আপ) নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানান, ‘মমতা দিদিও সাথে ফোনে কথা হয়েছে এবং আমি তাকে সমর্থন জানিয়েছি। মোদি-শাহ জুটির কার্যকলাপ সম্পূর্ণ ভাবেই অদ্ভুত ও গণতন্ত্র বিরোধী। আমরা এর তীব্র বিরোধিতা করি।’

এছাড়াও ট্যুইট করে মমতার ধরনাকে সমর্থন জানিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব, জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা, লোকতান্ত্রিক জনতা দল নেতা শরদ যাদব, রাষ্ট্রীয় জনতা দল নেতা তেজস্বী যাদব, কর্নাটকের উপ-মুখ্যমন্ত্রী জি.পরমেশ্বরা, ডিএমকে সভাপতি এম.কে.স্ট্যালিন, গুজরাটের পতিদার আন্দোলনের নেতা হার্দিক প্যাটেল, দলিত নেতা জিগনেশ মেবানি প্রমুখ। 

তবে ভিন্ন অভিমতও রয়েছে। অনেকের অভিমত রাজীব কুমারের বাড়িতে সিবিআই অভিযান-কে কেন্দ্র করে মমতা যেভাবে কেন্দ্রের সাথে সংঘাতে গেলেন বা সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করলেন-তা এক কথায় নজিরবিহীন। ১৩ বছর আগে ২০০৬ সালে সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় এই মেট্রো চ্যানেলেই ২৬ দিনের অনশন পর্ব চালিয়েছিলেন মমতা কিন্তু তখন ছিলেন রাজ্যটির বিরোধী দলনেত্রী। কিন্তু এখন তিনি একজন মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যটির প্রশাসনিক প্রধান। মমতার এমন সিদ্ধান্তে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কই খারাপ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। 

এদিকে সিবিআই-কর্মকর্তাদের টানাহিঁচড়া, আটক করে রাখাসহ অভূতপূর্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং রাজ্যটির রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠির সাথে ফোনে কথা বলেন। 

রাজীব কুমার ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে সিবিআই। আদালতের কাছে সিবিআই-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নীকারী সংস্থা (সারদা)-য় তদন্তের দায়িত্বে থাকা রাজীব কুমারের বিরুদ্ধে তথ্য লোপাটের অভিযোগ রয়েছে। আগামীকাল এই মামলার শুনানি হবে বলে জানা গেছে। 

সিবিআই-এর তৎপরতার ঘটনার আঁচ পড়ে দেশটির সংসদ-এও। সোমবার সংসদের অধিবেশন শুরুর পরই এই ইস্যুতে উত্তাল হয়ে ওঠে সংসদের দুই কক্ষ (রাজ্যসভা ও লোকসভা)। রাজ্যসভায় তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। তাকে সমর্থন করেন বিজেপি বিরোধী দলের সাংসদরাও। একসময় ওয়েলে নেমে এসে হট্টগোল শুরু করে দেয় তৃণমূল সাংসদরা। অধিবেশন মুলতবী করে দেওয়া হয় দুপুর ২টা পর্যন্ত। একই ইস্যুতে তৃণমূল, কংগ্রেস ও আরজেডি সাংসদদের হট্টগোলের জেরে লোকসভার অধিবেশনও দুপুর ১২টা পর্যন্ত মুলতবী করে দেওয়া হয়।


বিডি-প্রতিদিন/০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯/মাহবুব

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর