শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

পুরান ঢাকায় ভেজালের খনি নিয়ন্ত্রণে প্রভাবশালীরা

উৎপাদন বাড়ছেই সাজা সর্বোচ্চ দুই বছর

রাজধানীর পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অসাধু উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা হয়েছে ভেজাল পণ্যসামগ্রীর খনি। আর এসব খনির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে স্থানীয় বিভিন্ন প্রভাবশালী চক্র। ভেজাল ঠেকাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চললেও দোষীরা সাজা পায় মাত্র দুই বছর। ফলে উৎপাদন বাড়ছে হরহামেশা। গার্মেন্ট কারখানার কাপড় ধোয়ার কাজে ব্যবহৃত তরল সাবানের সঙ্গে বিভিন্ন রং ও সেন্ট মিশিয়ে শ্যাম্পু তৈরি করে অবৈধ ভেজাল পণ্যের রাজ্য গড়ে তুলেছে একাধিক চক্র। এ ছাড়া নিুমানের স্পিরিটের সঙ্গে রং মিশিয়ে সিরিঞ্জ দিয়ে খালি কনটেইনারে ভরে বডি স্প্রে তৈরি করে বাজারজাত করছে তারা। এমনিভাবে ভেজাল শ্যাম্পু ও বডি স্প্রেসহ বিভিন্ন ধরনের কসমেটিক্স তৈরি করে নামিদামি কোম্পানির মনোগ্রাম লাগিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সহজেই। নির্ধারিত ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু ও বডি স্প্রের অনুরূপ সেন্ট মিটফোর্ডে
পারফিউমের দোকান থেকে সংগ্রহ করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কসমেটিক্সের গায়ে হুবহু ওই সব কোম্পানির লেবেল লাগানো থাকায় আসল-নকল বোঝা দুরূহ হয়ে পড়ে সর্বসাধারণের কাছে। একইভাবে চিনি, লবণ ও হরলিকস মিশিয়ে বানানো হয় ওরস্যালাইন এম, ওরস্যালাইন এন, গ্লুকোজ-জাতীয় নানা ধরনের ওষুধ। এভাবে বছরের পর বছর ভেজাল কসমেটিক্স আর ওষুধ বিক্রি করে আসছে অসদুপায়ী চক্রগুলো। ওই সব ভেজাল উৎপাদনের খনি পুরান ঢাকার বংশাল, মালিটোলা, পাটুয়াটুলী, বাবুবাজার ও মিটফোর্ড এলাকায় বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এর আগে একাধিকবার এসব বাসাবাড়িতে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও র‌্যাব অভিযান চালিয়ে জব্দ করে ভেজাল পণ্য। তবু ঠেকানো যাচ্ছে না এসব পণ্যের বাজারজাতকরণ। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সাজা স্বল্প মেয়াদের এবং মাত্রা কম হওয়ায় প্রতিবারই আইনের ফাঁক গলে পার পেয়ে যায় দোষীরা।
জানা গেছে, সারা দেশ থেকে ব্যবহৃত পণ্যের খালি কনটেইনার জোগাড় করে নেওয়া হয় বংশাল ও মালিটোলা এলাকায়। ওই সব কনটেইনারে নকল প্রসাধনী ঢোকানো হয়। প্রভাবশালী ও অসাধু চক্রগুলো বিভিন্ন ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কাগজ ও খালি কনটেইনার কিনে নেয়। খালি কনটেইনার ব্যবহার করে পেনটিন, ডাব, হেড অ্যান্ড শোল্ডার, সানসিল্ক, ক্লিয়ারসহ বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু এবং মেক্সি, এক্স ও ডয়েটসহ নামি ব্র্যান্ডের বডি স্প্রে ও লোশন তৈরি করে বিক্রি করা হয়। মালিটোলার স্থানীয় প্রভাবশালী ময়না হাজির ১৫ নম্বর বাড়ির নিচতলায়, দোতলায় ও আশপাশে অন্তত ১৮টি ভেজাল কসমেটিক্স এবং নকল প্রসাধনী তৈরির কারখানা রয়েছে। ৭ জুলাই র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশার নেতৃত্বে এসব গোডাউনে অভিযান চালিয়ে প্রায় ১০ ট্রাক ভেজাল প্রসাধনসামগ্রী, তৈরির নানা উপকরণ, খালি কনটেইনার, কাগজের মোড়ক, লেবেল, হলোগ্রাম ও কাঁচামাল জব্দ করা হয়। এ সময় মো. আনোয়ার হাওলাদার ও মো. ছানোয়ার হাওলাদার নামে দুজনকে আটক করে তাৎক্ষণিকভাবে দুই বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া দুই লাখ করে মোট চার লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড প্রদান করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া মিটফোর্ড এলাকার বেশ কিছু কারখানাতেও এভাবেই নিয়মিত তৈরি হচ্ছে নকল প্রসাধনী আর ওষুধ। নকল প্রসাধনীগুলো বিক্রির জন্য সদরঘাট-গুলিস্তান রোডের বিভিন্ন স্থানের ফুটপাত কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। নকল প্রসাধনী ব্যবহার করে চর্মসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। গত বছরের ৮ জুন পাটুয়াটুলীর হামিদা মঞ্জিলের দ্বিতীয় তলায় ভেজাল ওষুধের কারখানায় অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু মালামাল জব্দ করে র‌্যাব। সেখানে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অস্বাস্থ্যকর ছোট্ট একটি জায়গায় বিভিন্ন ধরনের নকল ওষুধ তৈরি করে সারা দেশে বাজারজাত করে আসছিল। অভিযানে নকল ওষুধ তৈরির সময় কারখানাটির মালিক কেরানীগঞ্জের প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত আবদুল বারেককে গ্রেফতার করে তাৎক্ষণিকভাবে দুই বছরের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসব ভেজাল ওষুধের কারখানায় সুপার মার্কেট কোম্পানি নামের মোড়কে ওরস্যালাইন এম, ওরস্যালাইন এন, গ্লুকোজ, ডি-রেক্স, এটুজেড গোল্ড, এনজেলা গোল্ড ও ভেক্সড্রিম গোল্ডসহ অন্তত নয় ধরনের নকল ওষুধ তৈরি করা হয়। তৈরি করা নকল ওষুধগুলো মিটফোর্ডের ভূঁইয়া মার্কেটসহ আশপাশের দোকানগুলোতে পাইকারিভাবে বিক্রি করা হয়ে থাকে। আর এসব নকল ওষুধে সাধারণ মানুষের শারীরিক বিকলাঙ্গ ও জীবনহানির আশঙ্কা থাকে। জানা যায়, বিভিন্ন কোম্পানিতে দীর্ঘদিন ধরে কেমিস্ট ও ফার্মাসিস্ট হিসেবে কর্মরত ব্যক্তিরা নকল ওষুধ কারখানা খুলে অসাধু ব্যবসা শুরু করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মিটফোর্ড রোডের বিসিডিএস ভবনের একাধিক দোকানদার জানান, সরকারের তদারকি সংস্থাগুলো তুলনামূলক দুর্বল, যে কারণে ভেজাল ও নকল উৎপাদন বন্ধ করা যায় না। সংস্থাগুলোর দায়িত্বে যারা থাকেন তারা প্রভাবশালীদের কথায় ওঠাবসা করেন বলে নকল কোম্পানির মালিকদের কিছু হয় না।
তবে নকল ওষুধ থেকে সর্বসাধারণকে সতর্ক করতে বিভিন্ন প্রচারণা চালাচ্ছে বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতি। সংগঠনটির উপসচিব মনির হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নকল প্রসাধনী ও ওষুধ তৈরির কোম্পানিগুলোর মালিকরা অনেক প্রভাবশালী। তাই এসব বন্ধের কঠোর কোনো ব্যবস্থা সরকার নেয় না বলে উৎপাদন বেড়েই চলে। এ ক্ষেত্রে দোকানদারদের কোনো দোষ দেওয়া যাবে না। উৎপাদন হয় বলেই তো দোকানদারদের কাছে আসে। তিনি বলেন, হাতেনাতে এক কারখানার মালিককে ধরা হলেও সর্বোচ্চ দুই বছরের জেল দেওয়া হয়। পরে তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে আবারও সুন্দরভাবে আগের কাজ চালাতে থাকেন। এ ব্যাপারে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ এইচ এম আনোয়ার পাশা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মূলত ভেজাল ও নকল পণ্য তৈরির সঙ্গে একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত। র‌্যাবের ভেজালবিরোধী টিমের মাধ্যমে নকল সামগ্রী বানানোর উপকরণসহ যাদের আটক করা হয়, তাদের অনেকেই এ পেশার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। গ্রেফতারের পর এদের প্রত্যেককেই কারাদণ্ডসহ জরিমানা করা হয়। কিন্তু মুক্তি পেয়ে তারা আবারও কৌশল বদলে তাদের পুরনো পেশায় ফিরে যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর