সোমবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

দখল দূষণে নিশ্চিহ্ন ৩৬ খাল

দখল দূষণে নিশ্চিহ্ন ৩৬ খাল

বেপরোয়া দখল ও দূষণে রাজধানীর সব খালই এখন বিলীন হওয়ার পথে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত এ খালগুলো প্রভাবশালীদের নির্বিচার আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। অথচ একসময় স্বচ্ছ পানির উৎস ছিল এসব খাল। এর বেশির ভাগেরই এখন আর কোনো চিহ্ন নেই। যেগুলো কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে, বরণ করতে হয়েছে নালা-নর্দমার ভাগ্য। খাল ভরাট করে বিস্তৃত হয়েছে নগরী; গড়ে উঠেছে বাড়িঘর, শিল্পকারখানা ও রাস্তাঘাট।
রাজধানীর মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে জলাশয় বা খাল। আর কোনোমতে টিকে আছে যে ১৬টি খাল, সেগুলোও ধুঁকছে দখল আর দূষণের কবলে। ঢাকা শহরের জলাশয় ও খালের সুনির্দিষ্ট মানচিত্র বা তথ্য-উপাত্ত পর্যন্ত নেই সরকারের কাছে। খোদ ঢাকা ওয়াসা বলছে, সরকারি নথিতেই উধাও হয়ে গেছে, পাওয়া যাচ্ছে না ৩৯টি খালের হদিস। ঢাকায় ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ৫০টি খালের অস্তিত্ব ছিল। গত ২৯ বছরে এর ৩৬টি মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে গেছে। অবশিষ্ট ১৬টির মধ্যে মাত্র চারটির অংশ লেক হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও অন্যগুলো পেয়েছে নর্দমার আকৃতি। তাও ভরাট-দখলে ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। জানা গেছে, বেশির ভাগ খালের মধ্যে পরস্পর যোগসূত্র ছিল, এগুলোর সংযোগ ছিল রাজধানী লাগোয়া প্রধান চারটি নদীর সঙ্গে। যেমন- সূত্রাপুর লোহারপুল হয়ে বুড়িগঙ্গা, মোহাম্মদপুরের বসিলা হয়ে বুড়িগঙ্গা, উত্তরার আবদুল্লাহপুর হয়ে তুরাগ, উত্তরখান হয়ে তুরাগ, খিলক্ষেত ডুমনি হয়ে বালু ও মানিকনগর হয়ে শীতলক্ষ্যা নদী।
বর্তমান পরিস্থিতি : আবদুল্লাহপুর খালটি হরিরামপুর, রানাভোলা, আবদুল্লাহপুর, উত্তরা, দলিপাড়া হয়ে বাউনিয়ায় তুরাগ নদীতে গিয়ে মিশেছে। রাস্তা ও রাজউকের প্লটের কারণে খালটি এরই মধ্যে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়েছে। উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টর অংশে লেকের উত্তর প্রান্ত দখল করা হয়েছে ময়লা ফেলে। আবর্জনা দিয়ে ভরাট করে সেখানে প্লটও তৈরি করা হয়েছে। ১০ নম্বর সেক্টরের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বহমান খালটি এখন পুরোপুরি নর্দমা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের মাণ্ডা খাল সবুজবাগ থেকে শুরু হয়ে মাদারটেক, দক্ষিণগাঁওয়ের পাশ দিয়ে বালু নদে মিশেছে। দৈর্ঘ্য ৫ কিলোমিটার, প্রস্থ ৯ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত। দীর্ঘদিন ধরে এটি ওই এলাকার পয়ঃনিষ্কাশনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে দখল-দূষণে অনেক আগেই সঙ্কুচিত হওয়া খালটি এখন ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে গেছে। খাল কীভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন হলো, তার কূলকিনারা বের করতে পারেনি ওয়াসা। ভূমি-সংক্রান্ত কাগজপত্রে হাজারীবাগের খালটিও ব্যক্তিমালিকানার সম্পত্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে। রায়েরবাজার থেকে হাজারীবাগ হয়ে এ খালটি কামরাঙ্গীরচর সংলগ্ন বুড়িগঙ্গার শাখা নদীতে মিশেছে। এটি ওই এলাকার পয়ঃনিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম। সিএস, এসএ, আরএস অনুযায়ী এ জায়গা ছিল খাস সম্পত্তি। মহানগর জরিপে এটি ব্যক্তিমালিকানাধীন হিসেবে দেখানো হয়েছে।
জানা যায়, ২০০৭ সালে জাতীয় টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে খালটি ব্যক্তিমালিকানাধীন উল্লেখ করে অধিগ্রহণ করার সুপারিশ করা হয়। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে খালের বিবরণে উল্লেখ করা হয়, খালে ৮০টি কাঁচাঘর, ২৫টি দোকান, ছয়টি দোতলা ভবন, পাঁচটি ট্যানারিসহ মোট ১১৭টি স্থাপনা রয়েছে। স্থানীয় সাবেক কাউন্সিলর (ওয়ার্ড ৫৮) মুজিবুর রহমান মজু জানান, শুধু মহানগর জরিপ ছাড়া সব রেকর্ডে হাজারীবাগ খালকে খাল হিসেবেই দেখানো হয়েছে। কিন্তু এর আগের রেকর্ড মহানগরে এসে কীভাবে উল্টে গেল তা রহস্যজনক। তিনি জানান, হাজারীবাগ খালটি দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করতে ওয়াসা ও জেলা প্রশাসনকে একাধিকবার জানানো হলেও কারও কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি।
রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের মূল পথ সুতি খালের অস্তিত্ব এখন চরম সংকটে। ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে শত শত কাঁচাপাকা ও আধাপাকা স্থাপনা। প্রতিদিনই খালের কোনো না কোনো অংশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। গড়ে উঠছে স্থাপনা। এসব দেখার কেউ নেই। ভূমি দখলদার চক্র জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে সুতি খাল ও সরকারি জলাশয় দখল অব্যাহত রেখেছে। সুতি খালের সঙ্গে সংযুক্ত কুতুবখালী খালের অস্তিত্বও সংকটের মুখে। খালটির বেশির ভাগ অংশই দখল হয়ে গেছে। বিপাকে পড়েছে স্থানীয় হাজার হাজার মানুষ সুয়ারেজ লাইন ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে। খালটি ফের ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে। খালের উভয় পাড়ে স্থাপন করা হয়েছে শতাধিক দোকানপাট, কাঁচাবাজার, মাছ বাজার, মুরগির মার্কেটসহ নানা স্থাপনা।
আরও যেসব বেদখল : বিলীন ও বেদখল হয়ে যাওয়া আরও কয়েকটি খাল হচ্ছে- ক্যান্টনমেন্টের উত্তরাংশে বাউনিয়া খাল; মিরপুরের পল্লবী এলাকা ঘেঁষে যাওয়া বাউনিয়া খাল; পল্লবীর রূপনগর, ইস্টার্ন হাউজিং, বোটানিক্যাল গার্ডেনের উত্তর প্রান্ত দিয়ে যাওয়া দ্বিগুণ খাল; খিলগাঁও, বাসাবো ও সবুজবাগ এলাকা দিয়ে প্রবাহিত খিলগাঁও খাল; মুগদাপাড়া, জিরানী ও সবুজবাগ দিয়ে যাওয়া জিরানী খাল; শাহজাদপুর, খিলবাড়ির টেক, নুরেরচালা, বাড্ডা দিয়ে প্রবাহিত শাহজাদপুর খাল; মিরপুরের কসাইবাড়ী ও বোয়ালিয়া এলাকা দিয়ে প্রবাহিত বোয়ালিয়া খাল। এ ছাড়া খিলক্ষেতের পাতিরা ও ডুমনি এলাকা দিয়ে প্রবাহিত সুতিভোলা খালের ৮০ শতাংশেরই আর কোনো অস্তিত্ব নেই।
বারবার নিষ্ফল অভিযান : রাজউক, সিটি করপোরেশন ও ওয়াসা পৃথকভাবে ২০ দফা উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েও কল্যাণপুর খালটি রক্ষা করতে পারেনি। ওই খাল ২০০৭ সালেই ১১ দফা অভিযান চালিয়ে পুরোপুরি বেদখলমুক্ত করা হয়। কিন্তু দখলমুক্ত করা জায়গা পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা হয়নি। ফলে আবার বেদখল হয়ে গেছে বেশির ভাগ জায়গা। এখন খালটির অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে মাটি ভরাট হচ্ছে। উদ্যোগ চলছে বহুতল অট্টালিকা নির্মাণের। শুধু কল্যাণপুর খাল নয়, রাজধানীর বিলুপ্ত প্রায় ৩৬টি খাল উদ্ধারের ব্যাপারে ঢাকা জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে অন্তত ২১১ বার। রাজউক ও সিটি করপোরেশনে নিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটদের তত্ত্বাবধানেও পৃথকভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে একের পর এক বস্তিঘর, বিল্ডিং, স্থাপনা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে উদ্ধার করা জায়গাজমিও দুই সপ্তাহের বেশি সরকারি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। কারণ উচ্ছেদের পর খালের দুই পারে ওয়াকওয়ে নির্মাণ না করায় বা নার্সারি গড়ে না তোলায় আবার বেদখল হয়ে গেছে খালগুলো।
ভয়ঙ্কর দৃশ্যপট : খাল দখল করার কৌশলগুলোও প্রায় অভিন্ন। শুরুতে স্রোতস্বিনী খালের পানিতে খুঁটি পুঁতে মাচান বানিয়ে শত শত বস্তিঘর বানানো হয়। এরপর ময়লা-আবর্জনা, উচ্ছিষ্ট ফেলে ভরাট করা হয় খাল। ছোট ছোট বাঁধ দেওয়ারও নজির রয়েছে। একপর্যায়ে প্রভাবশালী মহল এগিয়ে যায়। গড়ে তোলে পাকা স্থাপনা ও বড় বড় অট্টালিকা। খাল-নালা দখল ও নিশ্চিহ্ন করার ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া রাজধানীজুড়ে শুরু হয়েছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে প্রতি বর্ষায়। জলাবদ্ধতায় নাকাল হন নগরবাসী। এদিকে পরিবেশবাদীরা অভিযোগে বলেছেন, ক্ষমতাসীনদের প্রচ্ছন্ন মদদে চোখের সামনে বিলীন হয়ে গেছে এসব খাল।
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, ৬৫টি খালের মধ্যে ২৬টি এখনো ভালো অবস্থায় আছে। এর মধ্যে ১৩টিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। বাকি ১৩টি খালের উদ্ধারকাজ শীঘ্রই শুরু হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর