শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা
নাগরিক যন্ত্রণা (৫)

ময়লা-বর্জ্যরে ভাগাড়ে বিপর্যস্ত পরিবেশ

বাড়িঘরেও উঠে আসে নর্দমার ময়লা

ময়লা-বর্জ্যরে ভাগাড়ে বিপর্যস্ত পরিবেশ

পাঁচ হাজারেরও বেশি ‘ঝুলন্ত খোলা পায়খানা’ মিরপুর-পল্লবীর বিরাট এলাকাজুড়ে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যস্ত করছে। ভাসানটেক, কালাপানি, কালশী, বেড়িবাঁধ এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে স্বচ্ছ পানির যেসব পুকুর, বিল-ঝিল ছিল, বস্তি আর শত শত খোলা পায়খানার কারণে সেগুলো এখন ময়লা-আবর্জনার জমাট নর্দমায় পরিণত হয়েছে। এসব নর্দমার উৎকট দুর্গন্ধে রাত-দিন বাতাস ভারি থাকে, দম বন্ধের উপক্রম হয়। এ কারণেই মিরপুর-পল্লবীর বেশির ভাগ এলাকায় সাংবাৎসরিক জলাবদ্ধতা থাকে, নোংরা কাদা পানির সরোবর পেরিয়ে তবেই চলাচল করতে হয় বাসিন্দাদের। এর মধ্যে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হলে আর উপায় নেই। নর্দমা-ঝিলের তরল ময়লা উঠে আসে অলিগলি, রাস্তায়, ঢুকে পড়ে বাড়িঘরেও।
পল্লবীর কালশী এলাকার বাসিন্দা জয়নাল আবেদিন, সুরাইয়া বেগম, মুস্তাক আহমেদ, নূর ইসলাম রাজু, সহিদুল ইসলাম, ময়না আক্তার, শ্যামলী আক্তার, ঝর্ণা বেগমসহ অন্যরা জানান, আধা ঘণ্টা বৃষ্টি হলে ১২-১৩ ঘণ্টা ধরে তার ধকল পোহাতে হয়। গলিপথে, বাড়িঘরে একবার নর্দমার ময়লা পানি ঢুকলে তা অপসারণ করা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এর কারণ হিসেবে নূর ইসলাম রাজু জানান, প্রধান প্রধান রাস্তা ছাড়া অলিগলির ড্রেনগুলো অনেক আগেই ভরাট হয়ে অকেজো। এসব ড্রেন দিয়ে পানি নামে না। তাই বাসিন্দাদের দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। গত দুই দিন সরেজমিন গিয়ে ময়লা-আবর্জনা-নর্দমাজনিত চরম ভোগান্তির বেহালচিত্র দেখা গেছে।
মিরপুর সেনপাড়া ও ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে পল্লবীর প্রান্তসীমা বেড়িবাঁধ পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার দীর্ঘ প্রধান সড়ক। এ সড়কের ডান-বামের শাখা সড়ক, অলিগলিজুড়ে ঘনঘিঞ্জি জনবসতি গড়ে উঠেছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের (উত্তর) মিরপুর জোন অফিসে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত সালাহউদ্দিন জানান, একযুগ আগেও মিরপুর-পল্লবী এলাকার বেশির ভাগ জায়গা ছিল উন্মুক্ত, ছিল ছোট-বড় অসংখ্য জলাধার। কিন্তু রাজধানীর অন্যান্য এলাকার বস্তি উচ্ছেদ করে হাজার হাজার বস্তিবাসীকে মিরপুর-পল্লবীতেই ঠেলে পাঠানো হয়। সালাহউদ্দিন বলেন, দেখতে দেখতে বিপুলসংখ্যক ছিন্নমূল মানুষ এই এলাকার ফাঁকা জায়গা-জমিতে কয়েকশ ঝুপড়ি বস্তি গড়ে তোলে। তারা বিল-ঝিলের পানির মধ্যেও বাঁশ-কাঠের পাটাতন বসিয়ে বসবাস শুরু করে। ফলে কয়েক বছরের ব্যবধানেই মিরপুর-পল্লবীর বিরাট জনপদ ‘নগরীর ডাস্টবিনে’ পরিণত হয়েছে। ‘বস্তি বিস্তারের কারণে পরিকল্পিত নগরায়নের গোটা কার্যক্রমই হুমকির মুখে পড়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন রাজউকের প্রকৌশলী সোলায়মান আলী। তিনি বলেন, মিরপুর অঞ্চলে বস্তির ছড়াছড়ি। ‘বালুর মাঠ বস্তি’ নামেই ৮-৯টি বস্তি আছে পল্লবীতে। এ ছাড়াও কালশী বস্তি, ১১ নম্বর রহমত ক্যাম্প বস্তি, রূপনগর বস্তিসহ নানা নামে নানা আকারে এলোপাতাড়ি ঝুপড়ি বস্তি বানানো হয়েছে, যেগুলোয় নিুআয়ের তিন লক্ষাধিক লোক বসবাস করে। তাদের সব জঞ্জালের দুর্ভোগ মিরপুর-পল্লবীবাসীকে পোহাতে হচ্ছে।’
খুবই বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত ২০০ টন ক্লিনিক্যাল বর্জ্যরে পাশাপাশি শিল্প-কারখানা, কাঁচাবাজার, ব্যবসা কেন্দ্র, হোটেল-রেস্তোরাঁ, নির্মাণ বর্জ্যসহ বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের উত্তর ও দক্ষিণের দফতর সূত্র জানায়, রাজধানীতে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে চার হাজার টন ময়লা-আবর্জনা জমে। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগ সর্বোচ্চ তিন হাজার টন ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করতে পারে। অবশিষ্ট দেড় হাজার টন ময়লা-আবর্জনা রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে, নর্দমায় আটকে থাকে। প্রতিদিনই জমে জমে বেড়ে ওঠা বর্জ্য-আবর্জনার ধকলে বেসামাল হয়ে পড়ছেন নগরবাসী। অধিকাংশ এলাকায় রাস্তাজুড়ে গলির মুখেই ফেলা হচ্ছে আবর্জনা। সেসব স্থান থেকে দিনভর সিটি করপোরেশনের গাড়িতে খোলামেলাভাবে ময়লা-আবর্জনা বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ডাম্পিং ডিপোতে। চলন্ত গাড়ি থেকে উৎকট দুর্গন্ধযুক্ত তরল ময়লা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ব্যস্ততম রাস্তায় রাস্তায়, যাত্রী-পথচারীর শরীরে লেগে নোংরা হয় জামাকাপড়।  ডিসিসির পরিচ্ছন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীতে এরকম ৪ হাজার ৬০০ ডাস্টবিন রয়েছে। ‘এখনো সব জায়গায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাস্টবিন স্থাপন করা যায়নি’ স্বীকার করে দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চাহিদার তুলনায় খুবই কম বাজেট বরাদ্দ দেওয়ায় অনেক জরুরি কাজও করা যাচ্ছে না।
টয়লেট থেকে কাঁচাবাজার : ডিসিসি নির্মিত প্রায় ৭০টি পাবলিক টয়লেট সবগুলোই ব্যবহারের অনুপযোগী। পথ-চলতি মানুষ বিপজ্জনক এ টয়লেটগুলো ব্যবহারের পরিবর্তে অবিবেচকের মতো ফুটপাতকেই টয়লেট বানিয়ে ফেলেছেন। ফলে মলমূত্রের কারণে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলাই এখন দুরূহ। রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলো একেকটি যেন ময়লা-আবর্জনার আধার। কাপ্তানবাজারের নোংরা ময়লা অব্যবস্থাপনা গুলিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত। রাস্তাজুড়েই ফেলে রাখা হয়েছে জবাই করা মুরগির নাড়ি-ভুঁড়ি, পালক, গরু-ছাগলের মলমূত্র। সেখানকার বেশির ভাগ ব্যবসা কেন্দ্রে শত শত মুরগি জবাই করে নাড়িভুঁড়িসহ সব ময়লা-উচ্ছিষ্ট সরাসরি রাস্তায় নিক্ষেপ করা হচ্ছে। যাত্রাবাড়ীর মাছের আড়তের আশপাশ দিয়ে দ্রুতগতির গাড়িতে চলাচলেরও জো নেই। দুর্গন্ধের ঝাপটায় এক মুহূর্তেই অসুস্থ বানিয়ে দেয়। আগারগাঁওয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তার একপাশ ময়লা-আবর্জনায় ভরা। ভোরের ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকার পরিবেশ খুবই নাজুক। ডিসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা বিপিন কুমার সাহা বলেন, ময়লা নিয়মিত পরিষ্কার করা না হলে ঢাকায় বাস করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত। কিছু এলাকায় ময়লা বাড়িঘরের এমন কোনায় কোনায় ফেলা হয় যে, সেখান থেকে গাড়িতে তুলে আনাও মুশকিল। তিনি বলেন, ‘অন্তত ২০ হাজার জনবল হলে এ মেগাসিটির পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা সম্ভব, অথচ ডিসিসির আছে মাত্র সাড়ে ৭ হাজার পরিচ্ছন্ন কর্মী। ময়লা বহনের জন্য কমপক্ষে আটশ গাড়ি দরকার, এর বিপরীতে আছে মাত্র আড়াইশ গাড়ি। এর মধ্যেও গড়ে ৩০-৩৫টি গাড়ি যান্ত্রিক ত্র“টির কারণে বিকল থাকে। তবুও আমরা সাধ্যানুযায়ী সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

সর্বশেষ খবর