শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা
শুক্রবারের বিশেষ প্রতিবেদন

প্রতিবন্ধীদের তৈরি মৈত্রী শিল্পের পণ্য দেশজুড়ে

সমাজ-সংসারের অবহেলিত প্রতিবন্ধীরা এখন আর কারও বোঝা হিসেবে থাকতে চান না। তারাও চান সমাজের দশজনের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে। স্বাভাবিক কাজকর্ম করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে। আর তেমনই এক বাস্তবতার সাক্ষী মৈত্রী শিল্পে উৎপাদিত নানা ধরনের পণ্য। এখানে প্রতিবন্ধীরাই তৈরি করছেন ৭০ ধরনের পণ্য। আর এই মৈত্রী শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে দেশে-বিদেশে।
রাজধানীর উপকণ্ঠে টঙ্গী শিল্প এলাকায় অবস্থিত ‘মৈত্রী শিল্প’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান, যার তত্ত্বাবধানে রয়েছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। প্রতিষ্ঠানটি শারীরিক প্রতিবন্ধী কল্যাণ ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত। এ প্রতিষ্ঠানে ৭৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এদের মধ্যে ৫৬ জন শারীরিক প্রতিবন্ধী। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রায় ৭৫ ভাগই প্রতিবন্ধী। শারীরিক প্রতিবন্ধী ছাড়াও এ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শ্রমিকও রয়েছেন। প্রতিবন্ধী শ্রমিকদের ৩৪ জন প্লাস্টিক ইউনিটে এবং ২২ জন ওয়াটার প্লান্টে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মানুষ আজ এই প্রতিবন্ধীদের হাতে তৈরি মৈত্রী শিল্পের পণ্য ব্যবহার করছেন দেদার। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে সচিবালয়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বোতলজাত বিশুদ্ধ যে পানি ব্যবহার করা হয়, তা উৎপাদনে জড়িত শ্রমিক-কর্মচারীদের অধিকাংশই শারীরিক প্রতিবন্ধী, যা অনেকেরই অজানা। আর এই মৈত্রী শিল্পে উৎপাদিত ‘মুক্তা’ ব্র্যান্ডের পানি মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকেও ব্যবহার করা হয়। সরকারি পর্যটন কেন্দ্রগুলোতেও এর চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। পর্যটন হোটেল অবকাশে গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘মুক্তা’ পানি। শুধু তা-ই নয়, মৈত্রী শিল্পের প্রতিবন্ধী শ্রমিকদের তৈরি প্লাস্টিকের বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্যসামগ্রী কেন্দ্রীয় কারাগারসহ জেলা পর্যায়ের সব কারাগারে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানের ওয়াটার প্লান্ট থেকে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার লিটার বিশুদ্ধ পানি উৎপাদন করা হয়। ৩০০ এমএল থেকে শুরু করে দুই লিটারের মোট পাঁচ রকম বোতলে বোতলজাত করে এ পানি বাজারে সরবরাহ করা হয়। সরবরাহকৃত পানি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে রিভার অসমোসিস পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ করা হয় বলে জানালেন ওয়াটার প্লান্ট সুপারভাইজার বশির। ক্রাচে ভর দিয়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে এই প্রক্রিয়া দেখান তিনি। সব প্রতিকূলতা পেছনে ঠেলে সামাজিক ভুল ধারণাগুলোকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জীবনযুদ্ধে টিকে আছেন এই প্রতিষ্ঠানের অনেকে। বশির বলেন, শুধু পানি নয়, পানির জন্য প্লাস্টিকের যে বোতল ব্যবহার করা হয় সেটিও এই প্রতিষ্ঠানেরই তৈরি। এ কারখানায় বোতলজাত ন্যাচারাল ড্রিংকিং ও মিনারেল ওয়াটারের পাশাপাশি গৃহস্থালি প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে ১৭ আকৃতির বালতি, ১৫ আকৃতির গামলা, দুই ধরনের জগ ও মগ, বিভিন্ন ধরনের বাটি, প্লেট, বদনা, ওয়েস্ট বাস্কেট, সেলফ ও হ্যাঙ্গারসহ ৭০ ধরনের পণ্য রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন আরমান খান নামের এক শারীরিক প্রতিবন্ধী। ছেলেবেলায় সমবয়সীরা যখন মাঠে ফুটবল খেলায় মেতে উঠেছে, তখন সেখানে তাকে থাকতে হয়েছে শুধু দর্শক হিসেবে।
 মন খারাপ করা সেই বিকালগুলোতে কেউ কেউ হয়তো তাকে সমবেদনা জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি সেটা চাননি। তিনি এ প্রতিবন্ধকতা দূর করতে চেয়েছেন আপন প্রচেষ্টায়। কিন্তু সেখানেও বাধা এসেছে। কারণ তাকে নিয়ে পরিবারের কোনো উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল না। ফলে অন্যান্য ভাইবোন পরিবার থেকে জীবন গড়ার ক্ষেত্রে যে সুবিধাটুকু পেয়েছেন, আরমান তা পাননি। এতে তিনি হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেননি। জীবনের এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এক পরিচিতজনের পরামর্শে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আরমান। এরপর হাতে-কলমে কাজ শেখার জন্য ২০০৬ সালে মৈত্রী শিল্পে যোগ দেন। আরমান বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের ওয়াটার প্লান্ট ইউনিটের উৎপাদন সহকারীর দায়িত্ব পালন করছেন। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর অন্য কোথাও কাজ না নিয়ে এখানেই কেন করছেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মৈত্রী শিল্প আমাদের জন্য আশীর্বাদ। সহকর্মীদের অধিকাংশই আমার মতো। ফলে বোঝাপড়া ভালো হয়।’ প্রায় একই কথা বললেন সহকর্মী মাদারীপুরের ফরিদ। তিনি ১৯৯৪ সাল থেকে মেশিন সহকারীর পদে কাজ করছেন।
 ফরিদ বলেন, মৈত্রী শিল্প আমাদের জন্য পরিবেশবান্ধব একটি প্রতিষ্ঠান। শারীরিক প্রতিবন্ধী হিসেবে এখানে যে সুবিধা পাই, অন্য কোথাও তা সম্ভব নয়। ফলে অন্য কোথাও কাজের কথা কখনো ভাবিনি।
আরমান ও ফরিদদের জীবনের গল্প প্রায় এক। এক জীবনের প্রায় সবখানেই যেন শুধু আশাভঙ্গ আর বেদনার গল্প। কিন্তু সেই গল্পেও এসেছে পরিবর্তন। আর এটি সম্ভব হয়েছে মৈত্রী শিল্পের কল্যাণে। প্লাস্টিক ইউনিটের স্টোরকিপার হাফিজুর রহমান। নিজে হুইল চেয়ারে বসেই সব দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এ কারখানায় রয়েছেন ১৯৯০ সাল থেকে। তিনি জানান, প্লাস্টিকের পণ্য উৎপাদনের মধ্য দিয়েই এ শিল্প কারখানার যাত্রা শুরু। গৃহস্থালি এসব সামগ্রী সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহের পাশাপাশি খুচরা বিক্রি করা হয়। এ জন্য রাজধানীর গুলিস্তান কমপ্লেক্সে শো-রুম রয়েছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের সামনেও গড়ে তোলা হয়েছে বিক্রয়কেন্দ্র। এ ছাড়া উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় প্রতিনিধি, ডিলার নিয়োগের মাধ্যমে গ্রাহকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (প্রশাসন) নাজমা বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে যে আয় হয়, সেখান থেকেই যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করার লক্ষ্য নিয়ে আমরা ১৯৮৩ সালে পণ্য উৎপাদন শুরু করি। যথাযথ প্রচারের অভাব সত্ত্বেও আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি পণ্যগুলো গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে।’ তবে গ্রাহকের কাছে পণ্যগুলো পৌঁছে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তারা জানছেন না এর পেছনের মানুষগুলোর প্রতিবন্ধকতা জয় করার গল্প। প্রতিবন্ধী মানেই যে পরিবার বা সমাজের বোঝা নয়, সে কথা প্রমাণ করেছেন এখানকার প্রতিটি কর্মী।

সর্বশেষ খবর