শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

মানব পাচার রুট কক্সবাজার

* স্বপ্নবাজদের মরণযাত্রা চলছেই * ধরাছোঁয়ার বাইরে পাচার চক্র

মানব পাচার রুট কক্সবাজার

প্রশাসনের কড়াকড়ির পরও থামছে না স্বপ্নবাজদের মরণযাত্রা। চিহ্নিত দালালদের ছত্রছায়ায় প্রতিদিনই জেলার বিভিন্ন পয়েন্ট হয়ে সাগরপথে লোকজনের মালয়েশিয়া যাত্রা চলছেই। মানব পাচার করে অনেকে ফ্ল্যাট বাড়ি ও জমির মালিক বনে গেছেন। হাঁকাচ্ছেন দামি গাড়ি। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও কোনো সমস্যা নেই। স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা তো আছেন। টাকা দিয়েই সব ম্যানেজ করে নেবেন তারা। কারণ, নেতা ও পুলিশ পাচারকারীদের দৃষ্টিতে ‘কেনা গোলাম’।
প্রশাসনের কড়াকড়ি সত্ত্বেও এ এলাকা দিয়ে মানব পাচার অব্যাহত থাকার পেছনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতাদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারাই মূলত মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু লোকজন জড়ো করে পাচার করেন। অনেক লোককে কাজ দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাসে এনে জোরপূর্বক ট্রলারে তুলে দেয় ওই সিন্ডিকেট। ওপারে পৌঁছার পর তাদের স্বজনের কাছ থেকে আদায় করা হয় মুক্তিপণ।
সাগরের সঙ্গে প্রাণপণ যুদ্ধ, নিহত বা আহত হওয়া, জেল, বন্দী করে মুক্তিপণ আদায় ও নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা চলমান সময়ে নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পদে পদে বিপদ আর উত্তাল সাগরে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও মরণযাত্রা করছেন তারা। তারা মার খান। আবার ঘুরে দাঁড়ান। শুনতে হয় মা-বাবা আর স্ত্রী-সন্তানের বুকফাটা কান্না। এক সীমান্ত পার হয়ে অন্য সীমান্তে আটকা পড়েন। মুক্তিপণ দিয়ে আবার ছাড়া পান। এভাবে মার খেতে খেতে স্বপ্নের মালয়েশিয়া কেউ পৌঁছে যান। কেউ বা ট্রলারডুবিতে নিখোঁজ রয়ে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। আবার কেউ কেউ অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে পড়ে থাকেন অনেক দিন। পরে তাদের বন্দীদশার করুণ কাহিনী স্বজনের কাছে পৌঁছে। ভিটেমাটি বিক্রি করে ছাড়া পেয়ে কেউ কেউ ভালো চাকরি করে সংসারের অভাব দূর করতে চেষ্টা করছেন। ভাগ্য আর দুর্ভাগ্য, এভাবেই চলছে মালয়েশিয়াগামী স্বপ্নবাজদের মরণযাত্রা। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও দালালসহ মালয়েশিয়াগামী যাত্রী আটক হচ্ছে। তবুও থেমে থাকছে না মানব পাচার। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অনেক চেষ্টা- প্রচেষ্টা, সাধ্য-সাধনা করেও ঠেকাতে পারছেন না সর্বনাশা এ তৎপরতা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সহজসরল লোকজনকে প্রলোভনে ফেলে সমুদ্রপথে অনিশ্চিত গন্তব্যে পাচার করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজার পৌরসভার নাজিরারটেক, কুতুবদিয়াপাড়া, সদরের পোকখালী, উখিয়ার সোনারপাড়া, ইনানী, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সেন্ট মার্টিন, মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ ও পেকুয়ার মগনামাঘাটসহ উপকূল তীরবর্তী আরও বেশ কয়েকটি পয়েন্ট হয়ে মানব পাচার চলছে। এতে স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধির জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে। যারা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে লিয়াজোঁ রক্ষা করেন। তাই অধরাই থেকে যান আদম পাচারের গডফাদাররা। কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক পয়েন্ট দিয়ে মালয়েশিয়া মানব পাচার করে এলাকার ডজনাধিক লোক সম্প্রতি আঙুল ফুলে কলা গাছ বনে গেছেন। যাদের বিষয়ে স্থানীয় বেশ কয়েকটি দৈনিকে অনেকবার সংবাদও প্রকাশ হয়েছে। তারা বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার জোর আর টাকার গরমে কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছেন না। চলতি বছর ১১ জুন সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অদূরে বঙ্গোপসাগরে মানব পাচারকারী চক্রের হাতে ছয় হত্যার ঘটনা মনে করলে এখনো অনেকে আঁতকে ওঠেন। ওইদিন মালয়েশিয়াগামী ৩২২ যাত্রীকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। এদের মধ্যে ২০ ছিলেন গুলিবিদ্ধ। এর পরেও কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলজুড়ে মানব পাচারকারী চক্রের তৎপরতা থেমে নেই। পদে পদে বিপদ আর উত্তাল সাগরে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও মরণযাত্রা করছেন তারা। ওপারের সীমান্তে গিয়ে আটকা পড়ছেন। কক্সবাজারের উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে ‘মালয়েশিয়া আদম পাচার মৌসুম’। কক্সবাজার সদরের ফুলছড়ি এলাকার আবদুর রহিমের স্ত্রী জানান, তার স্বামী দালালকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে নাজিরারটেক ঘাট দিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাত্রা করেন। এক মাস তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। হঠাৎ একদিন এক মোবাইল নম্বর থেকে ফোন আসে। ফোনে কাঁদছেন তার স্বামী। থাইল্যান্ডের সীমান্তে দালালরা আটকে রেখেছেন। এখন ছাড়া পেতে লাগবে ৫০ হাজার টাকা। ধার-দেনা করে দালালের দেওয়া বিকাশ মোবাইল নম্বরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় টাকা। তারও এক সপ্তাহ পর আবার আটক করা হয় মালয়েশিয়া সীমান্তে। কক্সবাজার পুলিশ সুপার শ্যামলকান্তি নাথ জানান, মানব পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে পুলিশ যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। জঘন্য এ কাজে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবেই।

সর্বশেষ খবর