বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

সড়কবাঁকে ১৪৪ মরণফাঁদ

পাঁচ বছরে ১১০০ দুর্ঘটনা তিন হাজার প্রাণহানি

সড়কবাঁকে ১৪৪ মরণফাঁদ

মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকেও চলে ওভারটেকিং -রোহেত রাজীব

দেশের সড়ক-মহাসড়কে বিপজ্জনক বাঁক আর অবৈধ অ্যাপ্রোচ রোডগুলো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। চরম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ১৪৪টি সড়কবাঁকে পাঁচ বছরে ১১ শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রায় তিন হাজার ব্যক্তি নিহত ও ১০ সহস্রাধিক আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন সহস্রাধিক ব্যক্তি।
পুলিশ সদর দফতর, হাসপাতাল, সড়ক নিরাপত্তায় বিভিন্ন কর্মসূচি চালানো একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসহ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) সারা দেশের সড়কগুলোয় সমীক্ষা চালিয়ে ২০৯টি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক থাকার কথা উল্লেখ করে। এর মধ্যে ১৪৪টি বাঁককে ‘মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে চিহ্নিত করে সরকার। বিপজ্জনক ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রয়েছে- কুমিল্লা জোনে ৮টি, সিলেট জোনে ১৪টি, চট্টগ্রাম জোনে ৩২টি, খুলনায় ১১টি, বরিশাল জোনে ১২টি, ঢাকা জোনে ১৯টি, উত্তরবঙ্গের রংপুর জোনে ২২টি ও রাজশাহীতে ২৬টি। এসব বাঁক প্রশস্তকরণসহ একাধিক লেনে পরিণত করার মাধ্যমে দুর্ঘটনা রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার নানা পরিকল্পনা হাতে নেয় সরকার। কিন্তু বছরের পর বছর সেসব পরিকল্পনা শুধু নকশা আঁকাআঁকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। বাস্তবানুগ কোনো পদক্ষেপ আজও নেওয়া হয়নি। পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে নিতেই এতসব দুর্ঘটনা আর ক্ষয়ক্ষতি। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অতিসম্প্রতি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সারা দেশের সড়ক, মহাসড়কগুলোর দুর্ঘটনাপ্রবণ ১৪৪টি বাঁক প্রশস্ত করার কাজ খুব দ্রুত শুরু হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ কাজের জন্য ১৬৫ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, অনেকেই মনে করেন রাস্তায় স্পিড ব্রেকার থাকলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে যায়, কিন্তু এ ধারণাটি ভুল। তাই স্পিড ব্রেকার কমিয়ে সড়কের বিপজ্জনক বাঁকগুলো প্রশস্তকরণ ও চার লেনে উন্নীতকরণের পদক্ষেপ শীঘ্রই বাস্তবায়ন হচ্ছে।
নান্দনিক বাঁকে বাঁকে : বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সড়কের একেকটি বিপজ্জনক মোড়ও যেন পর্যটকদের কাছে নান্দনিক হিসেবেই দেখা দেয়। কিন্তু প্রতিটি বাঁকই ভয়াবহ দুর্ঘটনা আর জানমালের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনে প্রায়ই। বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার এলাকার অনেক সড়ক-মহাসড়কের বিপজ্জনক বাঁক-মোড়ে কোনো চিহ্ন দেওয়া নেই। বাঁকের শেষ মাথা পর্যন্ত না পৌঁছালে বোঝা যায় না বাঁক পেরিয়ে রাস্তাটি কোন্ দিকে মোড় নিয়েছে। বান্দরবান সড়কের নান্দনিক বাঁকে বাঁকে মৃত্যু ওতপেতে থাকে। বান্দরবান থেকে থানচি পর্যন্ত যাওয়ার সড়কটি অধিকাংশ স্থানেই অতিমাত্রায় সরু। কিছুদূর পরপরই রয়েছে অতি বিপজ্জনক মোড়। সড়কের কোনো কোনো স্থানে বিপরীতমুখী দুটি গাড়ি অতিক্রম করতে পারে না। চট্টগ্রাম-হাটহাজারী-নাজিরহাট-রাউজান সড়কের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১৮টি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে। ফলে প্রতিদিন এ মহাসড়কে ঘটছে দুর্ঘটনা। এ মহাসড়ক দিয়েই দুই পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়িসহ ২৮টি রুটের যানবাহন সীমাহীন ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। এসব বাঁকে যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষজনিত দুর্ঘটনাই ঘটে বেশি। চট্টগ্রাম নগরীর অক্সিজেন মোড় থেকে হাটহাজারী মহাসড়ক বাসস্ট্যান্ড মোড় পর্যন্ত ১৫ কি.মি. সড়কে অন্তত পাঁচটি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে। বাঁকগুলোর ব্যাপারে সওজ কর্তৃপক্ষ যানবাহন চালকদের কোনো ধরনের সতর্কতামূলক নির্দেশিকাও দেয়নি।
কক্সবাজার রোডে : চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ২০টি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক এখন মরণফাঁদ হয়েছে। মহাসড়কে চলাচলরত গাড়ি এসব বাঁকে এসে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায়শ দুর্ঘটনার শিকার হয়। বাঁকগুলো সোজাকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না সড়ক বিভাগ। এমনকি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ এসব বাঁকের কোনোটিতেই লাগানো হয়নি কোনো সতর্কচিহ্ন বা ট্রাফিক সাইন। বিশেষ করে রওশনহাট, বুলারতালুক মোড়, চা বাগান রাস্তার মাথা, বাইন্যা পুকুরপাড়, বাগিচাহাট মোড়, দেওয়ানহাট, দোহাজারী উচ্চবিদ্যালয় মোড়, কাটগড় বিওসি মোড়সহ বেশ কয়েকটি স্থানে বিপজ্জনক বাঁক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
কুমিল্লা বিশ্বরোড এখন সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত : বিশ্বরোড নামে পরিচিত দেশের বৃহত্তম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার ৯৭ কিলোমিটার অংশ যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। বিপজ্জনক বাঁক, অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি চালনা, ওভারটেকিং, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি, মহাসড়কের ওপর যানবাহন থামিয়ে যাত্রী ও মালামাল ওঠানামার কারণে প্রতিদিনই কুমিল্লা জোনে দুর্ঘটনা ঘটছেই। এর ফলে প্রতিনিয়ত মহাসড়ক জুড়ে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জটে আটকে থাকতে হচ্ছে বাস, ট্রাক, লরিসহ বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহন। জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি সময় ও অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে যাত্রীদের। গত তিন মাসে বিশ্বরোডের কুমিল্লা অংশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৮৩ জন। এ সময় আহত হয়েছেন অন্তত আড়াইশ যাত্রী।
পটুয়াখালী-কুয়াকাটা সড়কে : পটুয়াখালী-কুয়াকাটা ৭২ কিলোমিটার মহাসড়কে ২৫টি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে। এর মধ্যে চরম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে ৬টি বাঁক। এসব বাঁকের পাশে রয়েছে বড় বড় গাছ। সড়কও তেমন প্রশস্ত নয়। মোড়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কিছু দেখা যায় না। অথচ প্রতিদিন কয়েকশ যানবাহন এ সড়কে চলাচল করে এবং প্রায়ই দুর্ঘটনাকবলিত হচ্ছে। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা এনএসএস-এর তথ্যানুযায়ী, গত দুই বছরে পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কে ২১০টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় মারা যান শতাধিক ব্যক্তি এবং আহত হন প্রায় ২ হাজার ২০০। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক শাহাবুদ্দিন পান্না জানান, আহত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ মানুষ চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছে।  
১৮ মাইলে ৩৮ বাঁক : পাইকগাছা বাসস্ট্যান্ড থেকে ১৮ মাইল সড়কে প্রায় ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক যেন একেকটি মরণফাঁদ। প্রতি বছর এসব ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকের কোনো না কোনোটিতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে চলেছে। তা ছাড়া এ সড়কের দুই পাশ দখল করে প্রভাবশালীরা গড়ে তুলেছে দোকানপাট। এতে দুর্ঘটনা ও যানবাহন চলাচলের ঝুঁকি আরও বেড়ে গেছে। ‘এস’ ও ‘এল’ আকারের ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকগুলোতে সর্বাধিক দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন পরিবহন সংশ্লিষ্ট মালিক-শ্রমিকরা। এ সড়কে পিচের মাথা মোড়, মানিক তলা মোড়, কার্তিকের মোড় ও সুলয়ার মোড় উল্লেখযোগ্য।
উত্তরাঞ্চলে বিপজ্জনক মোড় : উত্তরাঞ্চলের সড়ক-মহাসড়কে বিপজ্জনক মোড় আর অ্যাপ্রোচ রোডের যেন অভাব নেই। মাইলে মাইলে মোড়ের দেখা মেলে। কোনোটা ‘এল’ টাইপের কোনোটা বিপজ্জনক ‘এস’ টাইপের মোড় বা বাঁক। অতিসম্প্রতি নাটোরে মর্মন্তুদ দুর্ঘটনাস্থলটি ‘এস’ টাইপের বিপজ্জনক মোড় বলে জানিয়েছেন ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা। বিপজ্জনক এসব বাঁকে প্রায়ই ঘটছে কোনো না কোনো দুর্ঘটনা। অপরিকল্পিত এসব বাঁকের কারণে গত এক বছরেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন তিন শতাধিক ব্যক্তি।
ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক দ্রুত ঠিক করা হচ্ছে : সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দুর্ঘটনায় চালকদের জীবনও নিরাপদ নয়। চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনায় যাত্রীসহ চালকও নিহত হচ্ছেন। চালকদের ভালো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দক্ষ হয়ে গাড়ি চালাতে হবে এবং ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে। গতকাল ‘জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা দিবস’ উপলক্ষে কাকরাইলে র‌্যালির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন এ র‌্যালির আয়োজন করে।
 এ সময় নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন, হাজী এজাজুর রহমান শাহিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রী বলেন, সড়কপথে সারা দেশে ১৪৪টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান রয়েছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ স্থান দ্রুত ঠিক করা হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে শীঘ্রই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিয়ে সড়ক নিরাপত্তা ও সচেতনতার জন্য কাউন্সিলিং কর্মসূচি হাতে নেব। র‌্যালি শেষে শহীদ মিনারে সমাপনী বক্তব্যে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা কোনো মহামারী নয়। এটা মানুষ দ্বারা সৃষ্ট।
প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। তিনি বলেন, দেশের প্রত্যেকটি মহাসড়কে প্রতি ৪০ কিলোমিটার পরপর একটি করে ট্রমা সেন্টার প্রতিষ্ঠা করলে দুর্ঘটনায় আহত অনেক রোগীকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব। তিনি আরও বলেন, যাত্রীদের তাড়াহুড়ো ও চালকদের অদক্ষতাই দেশে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।

সর্বশেষ খবর