শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

লাগেজ পেতে শেষ নেই হয়রানির

লাগেজ পেতে শেষ নেই হয়রানির
যশোরের বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা তিন বছর পর সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন দুই মাস আগে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে কনভেয়র বেল্টে দীর্ঘ অপেক্ষার পর জানতে পান তার দুটি লাগেজ আসেনি। লাগেজে ছিল প্রিয়জনের কিছু দামি কসমেটিক, বাচ্চার চকোলেট আর কিছু ইলেকট্রনিক আইটেম। লাগেজ না পেয়ে তার যেন আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। কেন লাগেজ আসেনি তা জানার জন্য তিনি বার বার ছোটেন বিমান কর্মীদের কাছে। বিমানের দায়িত্বরত কোনো কর্মচারী তাকে লাগেজ হারানোর কারণ জানাতে পারেননি। অগত্যা তিনি এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। একপর্যায়ে তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডের একটি রসিদ। বলা হয়- কদিন পর রসিদসহ যোগাযোগ করতে। এরপর তিনবার তিনি ঢাকায় এসেছেন টাকা খরচ করে। কিন্তু ফিরে পাননি তার হারানো দুটি ব্যাগ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে গোলাম মোস্তফা বললেন, ‘ঘুরতে ঘুরতে আমি এখন ক্লান্ত’। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাগেজ পেতে যাত্রী হয়রানির এ দৃশ্য নিত্যদিনের। প্রতিদিনই বিদেশফেরত যাত্রীরা তাদের লাগেজ পেতে এমন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। যাত্রীদের অনেকেই ছোটাছুটি করে লাগেজ পেলেও দেখতে পান ব্যাগ কেটে দুর্বৃত্তরা লুটে নিয়ে গেছে মূল্যবান সামগ্রী। অনেকেই আবার হারানো লাগেজের খোঁজে ধরনা দিচ্ছেন দিনের পর দিন। কিন্তু মেলে না তাদের খোয়া যাওয়া লাগেজ। ঘুরতে ঘুরতে ত্যক্তবিরক্ত যাত্রীদের অনেকেই আবার ব্যাগ ফেরতের আশা ছেড়ে দেন। প্রতিদিন লাগেজের সন্ধানে যাত্রীদের আহাজারি করতে দেখা যায় বিমানবন্দরে। বিষয়টি দেখার যেন কেউ নেই। লাগেজ কবে পাবেন- এ প্রশ্নের উত্তরও বিমানের কেউ দিতে পারছেন না। বিমানবন্দরে সরেজমিন পরিদর্শন করে জানা গেছে বেশ কয়েকজন যাত্রীর সীমাহীন দুর্ভোগের কথা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় প্রতিদিনই ব্যাগ হারানোর অভিযোগ জমা পড়ছে বিমানবন্দরের লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড বিভাগে। যারা লাগেজ ফেরত পান না, তাদের এয়ারলাইনস থেকে জরিমানা দেওয়া হয়। তবে সংঘবদ্ধ একটি চক্র যাত্রীদের লাগেজ চুরি ও ব্যাগ কেটে মালামাল লুটের সঙ্গে জড়িত। বিমানবন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থার কিছু কর্মচারী ও বাইরের অপরাধীদের সমন্বয়ে একটি চক্র যাত্রীদের ব্যাগ ও মালামাল চুরির সঙ্গে জড়িত। লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড শাখার তথ্যে জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ লাগেজ হারানোর অভিযোগ আসে তাদের কাছে। কিন্তু হাতে গোনা কিছু লাগেজ পাওয়া গেলেও অধিকাংশ পাওয়া যায় না। জানা গেছে, ফ্লাইট বিলম্ব ও বৈদেশিক অফিসগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে হারানো লাগেজজট বাড়ছে। খুঁজতে গিয়ে চরম ভোগান্তি ও হয়রানিরও শিকার হতে হচ্ছে যাত্রীদের। হচ্ছেন নাজেহালও। মালামাল হারিয়ে কেউ ওই বিভাগে গেলে একটি রসিদ ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়- লাগেজ এলে টেলিফোনে জানিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সেই লাগেজ আর আসে না। টেলিফোনও কেউ করে না। লাগেজ হারানোর ঘটনায় সিভিল অ্যাভিয়েশন দায়ী করছে বিমানকে, অন্যদিকে বিমান দায়ী করছে সিভিল অ্যাভিয়েশনকে। বিমানবন্দর-সংশ্লিষ্ট একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, উড়োজাহাজ থেকে লাগেজ বেল্টে দেওয়ার আগমুহূর্তে লাগেজ কেটে মূল্যবান মালামাল সরিয়ে ফেলা হয়। অনেক সময় যাত্রীদের লাগেজ আসেনি বলে জানানো হয়। বলা হয়- পরবর্তী ফ্লাইটে আসবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরবর্তী ফ্লাইটে লাগেজ এলেও লাগেজ প্রকৃত মালিকের কাছে পৌঁছানো হয় না। লাগেজে দামি মালামাল থাকলে তো কথাই নেই। বলা হয়- ‘আপনার লাগেজে অবৈধ মাল এসেছে। আপনি সাধারণ যাত্রী। তাই এসব নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করা উচিত হবে না। বেশি ঘাঁটতে গেলে যে কোনো সময় গ্রেফতার হয়ে যেতে পারেন। গোয়েন্দারা লাগেজের মালিককে খুঁজছেন।’ এমন পরিস্থিতিতে অজানা আতঙ্কে অনেক যাত্রীই লাগেজের আশা ছেড়ে দেন। অনেক সময় যাত্রী মোটা টাকার বিনিময়ে লাগেজ সংগ্রহ করেন। মধ্যপ্রাচ্যের যাত্রীরাই লাগেজ হারাচ্ছেন বেশি। বিমানবন্দরে কর্মরত লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডের কর্মীরা জানান, প্রতিদিন রিয়াদ থেকে আগত শত শত যাত্রী লাগেজ হারানোর অভিযোগ করছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যাত্রী আসার পরদিন লাগেজ আসে। এভাবে গত এক মাসে শতাধিক লাগেজ জমা হয়ে গেছে। লাগেজ হারানোর তুলনায় পাওয়ার সংখ্যা অনেক কম। রূপগঞ্জের হাবিবুর রহমান ও বলদিয়ার মুক্তার হোসেন রিয়াদ থেকে ছয়টি লাগেজ নিয়ে ঢাকা আসেন। বেল্টে চার ঘণ্টা অপেক্ষার পর জানতে পেলেন তাদের তিনটি লাগেজ এসেছে। বাকি তিনটি আসেনি। এ পর্যন্ত তারা তিনবার বিমানবন্দরে এসেছেন। লাগেজ না পেয়ে তাদেরও হৈচৈ করতে দেখা গেছে।
সৈয়দপুর থেকে আসা আলমগীর বলেন, “গত মাসে লাগেজ নিয়ে রিয়াদ থেকে ঢাকায় এসে দেখি একটা লাগেজ নেই। লাগেজ কেন আসেনি- জানতে চেয়েছিলাম উপস্থিত বিমানকর্মীদের কাছে। তারা সেদিন জানিয়েছিলেন ‘প্রতিদিনই এরকম ঘটছে। আপনি অভিযোগ দিয়ে চলে যান’।” এমন দুর্ভোগের শিকার মুন্সীগঞ্জের মনির শেখ, ঢাকার সাজেদুল আলম, টাঙ্গাইলের এরশাদ, ময়মনসিংহের আহমদসহ অন্তত ১৫ জন রিয়াদফেরত যাত্রী। তারা সবাই জানান তাদের লাগেজ হারানোর কথা।
বিমানবন্দরে লাগেজ চুরি ও লাগেজ কাটার সংঘবদ্ধ চক্রের মূল হোতা জয়নাল গ্রেফতার হলেও বন্ধ হয়নি লাগেজ চুরির ঘটনা। তার বাহিনীর লোকজন বিমানবন্দরের ভিতরে বাইরে এখনো সক্রিয়। এপিবিএনের (আর্মড পুলিশ) সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আলমগীর এইচ শিমুল জানান, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাগেজ চোর সিন্ডিকেটের প্রধান জয়নাল আবেদীন। বিমানবন্দরের ১ নম্বর ক্যানোপি এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড বিভাগের কয়েকটি জাল ডেলিভারি স্লিপ (অ্যাডভাইস) ও তিনটি পাসপোর্ট। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি লাগেজ চুরির অভিযোগে আর্মড পুলিশ জয়নালকে গ্রেফতার করে। এ সময় তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় একটি সনি ভেগা টিভি। পরে তার দেওয়া তথ্যমতে দক্ষিণখানের কাউলা বাজার এলাকার একটি বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় এক ট্রাক চোরাই লাগেজ, কসমেটিকস, কম্বলসহ অন্যান্য মালামাল। এর আগেও পুলিশ তাকে একাধিকার গ্রেফতার করেছিল। সম্প্রতি জামিনে বের হয়ে আবারও একই ব্যবসায় লিপ্ত হয়েছেন তিনি। এপিবিএনের এএসপি আলমগীর জানান, বিমানে চাকরির সুবাদে বিমানবন্দরের অনেকের সঙ্গেই জয়নালের সখ্য রয়েছে। লাগেজ চুরির জন্য জয়নাল লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড বিভাগের ডেলিভারি স্লিপ (অ্যাডভাইস) জাল করে থাকেন। তিনি জানান, কয়েক দিন আগে বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল লাগেজ বেল্ট থেকে তিনটি লাগেজ চুরি করার সময় গ্রেফতার হন জরিনা বেগম নামে একজন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জরিনা বেগম স্বীকার করেন জয়নাল আবেদীনের সহায়তায় তিনি লাগেজ চুরি করেন। এর পর থেকে জয়নালের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। পুলিশের কাছে তিনি স্বীকার করেন, বিমানবন্দরের ভিতরে চুরির কাজে কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী তাকে সহায়তা করে আসছিলেন।

সর্বশেষ খবর