শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

আয় করেন কোটি টাকা কর দেন ৫ হাজার

এক হাজার চিকিৎসকের নথি তলব এনবিআরে

পেশায় তারা চিকিৎসক। প্রতিদিনই রোগী দেখেন, অপারেশন করেন, আবার বিভিন্নভাবে কমিশনও পান। এদের বছরে আয় কয়েক লাখ থেকে কোটি টাকার অঙ্কে। কিন্তু এমন চিকিৎসকদের অধিকাংশই বছরে সরকারকে আয়কর দেন মাত্র ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। ৯০ শতাংশই প্রকৃত আয় গোপন করে কর ফাঁকি দেন। তবে ব্যতিক্রমও আছেন, যারা মধ্যসারির করদাতা হিসেবে বছরে আয়কর দেন ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। আবার হাতে গোনা কয়েকজন দেন অর্ধ কোটিরও বেশি টাকা। রাজধানীর এমন নামিদামি প্রায় দুই শতাধিক চিকিৎসকের আয়কর ফাইল তলবের পর, এবার সারা দেশের আরও ৮০০ চিকিৎসক করদাতার আয়কর নথি তলবের নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, দেশে সর্বমোট ৬০ হাজার চিকিৎসক থাকলেও রাজধানীতে প্রায় ১০ হাজার চিকিৎসক করদাতা। আর সারা দেশে তাদের সংখ্যা ২০ হাজারের অধিক। অনেক চাকরিজীবী চিকিৎসক আছেন, যারা বেসরকারিভাবে রোগীদের সেবা দিয়ে থাকেন। তাদের বেতনের আয়কর পরিমাণে কম হলেও, অন্যান্য আয়ের ওপর আনুপাতিক হারে সরকারকে কর দিচ্ছেন না। সমাজের অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষের মতো দেশের এই সচেতন চিকিৎসকদেরও আয়কর কম দেওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিকিৎসক করদাতাদের মাত্র ১৫ শতাংশ ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা আয়কর দেন। আর ৫ লাখ টাকা কর দিলে করদাতার বার্ষিক আয় দাঁড়ায় প্রায় ৩০ লাখ টাকার মতো। কিন্তু এনবিআরের কাছে তথ্য আছে, কয়েক হাজার চিকিৎসকের বার্ষিক আয় কোটি টাকার ওপরে। আর দেশের অধিকাংশ সাধারণ চিকিৎসক বছরে মাত্র ৫, ১০, ২০ বা ৫০ হাজার টাকা করে আয়কর দেন। তারাও প্রকৃত তথ্য গোপন করে আয়কর ফাঁকি দিচ্ছেন। অথচ সমাজের অগ্রগামী সচেতন নাগরিক হিসেবে তাদের আরও বেশি কর পরিশোধ করা উচিত বলে মনে করেন কর কর্মকর্তারা। দীর্ঘদিন কর ফাঁকি দিয়ে আসছেন, এমন দুই শতাধিক চিকিৎসক করদাতার আয়কর নথি সম্প্রতি তলব করেছে এনবিআরের কর গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি)। সংস্থাটির কলেবর তুলনামূলক ছোট হাওয়ায় কর ফাঁকি দিচ্ছেন সন্দেহ হচ্ছে, এমন আরও ৮০০ করদাতার নথি তলব করতে নির্দেশ দিয়েছে এনবিআর। সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলগুলো এসব করদাতার ব্যাংক হিসাব থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে বলে জানা গেছে। তাতে দেখা গেছে, দেশের নামিদামি এই চিকিৎসকরা জমি, ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়ি আর দেশে-বিদেশে বিশাল অঙ্কের সঞ্চয় থাকলেও তা গোপন করেছেন। প্রতিদিনই বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গোপনীয় চিঠি দিয়ে ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ব্যাংকিং লেনদেনের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে এনবিআর চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইতিমধ্যে প্রায় ২০০ চিকিৎসক করদাতার আয়কর ফাইল তলবের জন্য সিআইসিকে বলা হয়েছে। এ ছাড়া আরও ৮০০ চিকিৎসক করদাতার আয়কর ফাইল তলবের জন্য সারা দেশের সংশ্লিষ্ট কর কমিশনারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এ প্রক্রিয়ায় কোনো জোরজবরদস্তি করে নয়, বরং করদাতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেই সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব আদায় করতে চায় এনবিআর। জানা গেছে, সিআইসি ও বিভিন্ন কর অঞ্চল এসব করদাতার ফাইল তলব করার পরিপ্রেক্ষিতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই জরিমানাসহ ফাঁকি দেওয়া সব কর পরিশোধ করতে আয়কর বিভাগের কাছে অনেকে মিনতি করছেন। তবে আইন অনুযায়ী তাদের কর নথি পুনঃ উšে§াচিত হবে। কর ফাঁকির জন্য ৩০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। একই সঙ্গে চলবে কর মামলা। প্রয়োজনে ব্যাংক হিসাব জব্দ করেও আয়কর আইনে অর্থ আদায়ের সুযোগ আছে। তবে আয় গোপনকারী চিকিৎসকের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছে এনবিআর। জানা গেছে, সিআইসি থেকে পাঠানো চিঠিতে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্রোকারেজ হাউসকে এই বলে সতর্ক করা হয়েছে যে, উপযুক্ত কারণ ছাড়া ছক অনুযায়ী হিসাবধারীর পূর্ণাঙ্গ তথ্যাবলি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরবরাহ করা না হলে আয়কর অধ্যাদেশের ধারা ১২৪(২) অনুযায়ী এককালীন ২৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং পরবর্তীতে প্রতিদিনের জন্য ৫০০ টাকা হারে জরিমানা আরোপ করা হবে। একই সঙ্গে ১৬৪ সিসি ধারায় অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ড আরোপের লক্ষ্যে ফৌজদারি মামলা করা হবে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জে পাঠানো সিআইসির গোপনীয় পত্রে ২০০৭ সালের ১ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত সব ধরনের ব্যাংক হিসাব বিবরণী সাত দিনের মধ্যে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশের ধারা ১১৩ (এফ) অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের একক বা যৌথ নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এফডিআর ও এসটিডিসহ যে কোনো মেয়াদি আমানতের হিসাব, যে কোনো ধরনের বা মেয়াদের সঞ্চয়ী হিসাব, চলতি হিসাব, ঋণ হিসাব, ফরেন কারেনসি অ্যাকাউন্ট, ক্রেডিট কার্ড বা ডেবিট কার্ড হিসাব, ভল্ট, সঞ্চয়পত্র বা যে কোনো সেভিংস ইনস্ট্র–মেন্ট হিসাবসহ আগে ছিল কিন্তু বর্তমানে বন্ধ আছে এমনসব হিসাবের বিস্তারিত বিবরণী নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী পাঠাতে বলা হয়েছে। জানা গেছে, দিনে কমপক্ষে ৫০ হাজার থেকে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করেন এমন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দিকেই নজর বেশি এনবিআরের। দেশের ৬০ হাজার চিকিৎসকের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সহ-সাধারণ সম্পাদক ডা. এম এ আজিজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার নিয়ম অনুযায়ী এটা করতে পারে। এ বিষয়টিকে বিএমএর অন্যভাবে দেখার সুযোগ নেই। জানা গেছে, সিআইসি যাদের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ডা. প্রজেশকুমার রায় ও তার স্ত্রী মিসেস সুপ্রীতি রায়, গাইনি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আনোয়ারা বেগম ও তার স্বামী প্রফেসর হাবিবুর রহমান, ড. এস এম আমজাদ হোসেন ও তার স্ত্রী ড. খায়রুন্নাহার, মেডিসিনের প্রফেসর মনসুর হাবিব, নিউরো বিশেষজ্ঞ ড. কনককান্তি বড়ুয়া, পেডিয়াট্রিক চিকিৎসক সেলিম উজ্জামান, গাইনির অধ্যাপক শাহলা ফেরদৌস, ল্যাবএইডের কার্ডিওলজির প্রফেসর বরেণ চক্রবর্তী, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সার্জারির অধ্যাপক এস এম আমজাদ হোসেন, শিশু হাসপাতালের ডা. রুহুল আমিন, ডা. কামরুল হাসান তরফদার, বাংলাদেশ আই হাসপাতালের ডা. নিয়াজ আবদুর রহমান, হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের প্রফেসর রওশন আরা বেগম, বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ডা. নাজমুন্নাহার, প্রফেসর সাহাবুদ্দীন তালুকদার, ডা. সামস মনওয়ার, প্রফেসর শহিদ করীম, প্রফেসর সেলিম মো. জাহাঙ্গীর, লুৎফুল আজীজ, প্রফেসর আনিসুর রহমান, প্রফেসর শান্তনু চৌধুরী, প্রফেসর জিল্লুর রহমান, প্রফেসর মাহবুবুর রহমান, ডা. প্রদীপ রঞ্জন সাহা, ডা. জাহাঙ্গীর কবীর, প্রফেসর এ কে এম ফজলুল হক ও ডা. অরুণকুমার শর্মা।

সর্বশেষ খবর