শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

শাহজালালে ঢিলেঢালা নিরাপত্তা

শাহজালালে ঢিলেঢালা নিরাপত্তা
ঢিলেঢালা নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্য দিয়েই চলছে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্যক্রম। ভুয়া নিরাপত্তা পাস ও ‘ডি-পাস’ ব্যবহার করে হামেশাই বিমানবন্দরের স্পর্শকাতর এলাকায় ঢুকে পড়ছেন বহিরাগতরা। অন্যদিকে, চোরাচালানকে উৎসাহিত করার প্রয়াসে এখনো একটি স্ক্যানার দিয়েই চলছে বিমানবন্দরের আগমনী বিভাগের কার্যক্রম। বিমানবন্দরের এসব অনিয়মের সঙ্গে সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ (সিএএবি), বিমান ও সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনসের দুর্নীতিগ্রস্ত নিরাপত্তা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরাসরি জড়িত বলে একাধিক গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।
অতীতে বিভিন্ন সময় বিমানবন্দরের অভ্যন্তর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার, কার্গো ভিলেজে বড় ধরনের চুরির পর অতিগুরুত্বপূর্ণ এবং নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত সংবেদনশীল এ স্থাপনার নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) উপস্থিতির পর বিমানবন্দরের নিরাপত্তাসহ পরিবেশগত অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের বিরোধিতার কারণেই আর্মড পুলিশ তাদের কর্মকাণ্ড অনেক সংকুচিত করতে বাধ্য হয়েছে। তবে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ও কাক্সিক্ষত সেবা নিশ্চিতের জন্য সিভিল অ্যাভিয়েশন, বিমান এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের কড়া জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভুয়া নিরাপত্তা পাস ও ডি-পাসের (ডিউটি পাস) ব্যবহার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের পাস দিয়ে হ্যাঙ্গার গেট, এয়ারফ্রেইড গেট, কার্গো ভিলেজ গেটসহ বিভিন্ন গেট ব্যবহার করে প্রতিদিন শত শত অবৈধ অনুপ্রবেশকারী অ্যাপ্রোন (যেখানে বিমান দাঁড়ানো থাকে বা অবস্থান করে থাকে) এলাকায় অবাধে ঢুকে যাচ্ছে।
গত ২৮ ফেব্র“য়ারি কার্গো ভিলেজ দিয়ে দুই রোহিঙ্গাকে ভুয়া পাসের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে পাঠানো হয়। সেখানে ইমিগ্রেশন পুলিশের সন্দেহ হলে ওই দুই রোহিঙ্গাকে যাত্রাবিরতি করানো হয়। সিএএবির কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ভুয়া পাস দিয়ে তাদের মালয়েশিয়া পাচার করছিলেন। এর আগে গত বছরের ৯ এপ্রিল আট নম্বর হ্যাঙ্গার গেট দিয়ে পাঁচ রোহিঙ্গাকে অবৈধভাবে সৌদি আরবে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তিন নিরাপত্তাকর্মীকে সাসপেন্ড করে সিএএবি কর্তৃপক্ষ। একই দিন গুলিভর্তি শটগান নিয়ে এক ব্যক্তি কার্গো ভিলেজের গেট দিয়ে ভিতরে সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়ে। গত বছরেরই ১৬ এপ্রিল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের দামি আমদানিপণ্য রাখার গুদাম থেকে এক কেজি হীরা চুরি হয়। ওই ঘটনায় বিমানের নিরাপত্তা ম্যানেজার ইদ্রিস আলী বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করেছিলেন।
সূত্র জানায়, বিমানবন্দরে সার্বক্ষণিক ২৯টি সংস্থা কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে বিমান, সিভিল অ্যাভিয়েশন, কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, এপিবিএন, এসবি, ডিবি, র‌্যাব এবং বিভিন্ন এয়ারলাইনস ও সংস্থা। তারা ডিউটি চলাকালে সিএএবি নিরাপত্তা পাস ও ডি-পাস ব্যবহার করে। আর এসব পাস ইস্যু করে সিএএবি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এই সিএএবি কর্তৃপক্ষের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে অবৈধ নিরাপত্তা পাস ও ভুয়া ডি-পাস ব্যবহার করে প্রতিদিন শত শত লোক প্রবেশ করছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ভুয়া নিরাপত্তা পাস ও ডি-পাস ব্যবহার করে অনেকে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে যায়। সেখান থেকে ভুয়া সিল দেওয়া হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনস আইনেস ও বোর্ডিং পাস দেয়। ইমিগ্রেশন ভিসা পাসপোর্টে সিল দেয়। পরে যাত্রী হোল্ডিং লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে থাকে। এরপর সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনস ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দেয়। এ সময় নিরাপত্তা তল্লাশি করে সিএএবি বিভাগ। পরে যাত্রী বিমানে ওঠার অনুমতি পায়। অন্যদিকে, বিমানবন্দরের বহির্গমন ইউনিটে ১৪টি স্ক্যানার থাকলেও আগমনী বিভাগে মাত্র একটি স্ক্যানার দিয়ে বিমানবন্দরের কার্যক্রম চলছে। এতে দেশে আগত অনেক যাত্রীর লাগেজই স্ক্যানিং করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার চোরাকারবারি চক্র আগমনী বিভাগে স্ক্যানিংয়ে দায়িত্বরত অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে নিয়মিতভাবে তাদের টার্গেট পূরণ করে যাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, চোরাচালানের মাত্র ১০-১৫ ভাগ ধরা পড়ে। পাচারকারী দলের সদস্যদের নিজেদের অন্তর্™^ন্দ্ব, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সদস্যদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কিছু সদস্যের সঙ্গে চোরাকারবারিদের ‘বনিবনা’ না হলেই ধরা পড়ে সোনার চালান। তাদের সবার সঙ্গে দফারফা হলেই কোনো সোনা আটক হয় না। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ জানান, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিশ্বের নাজুক বিমানবন্দরগুলোর একটি। বিমানবন্দরের বিদ্যমান নিরাপত্তাব্যবস্থার ওপর অনেক বিদেশি এয়ারলাইনসেরই আস্থা নেই। এ কারণে সব ধরনের নিরাপত্তা ধাপ পেরোনোর পর এই বিমানবন্দর থেকে কোনো যাত্রী প্লেনে ওঠার আগে তাকে সংশ্লিষ্ট ওই বিমানের পক্ষ থেকে পুনরায় বিশেষভাবে তল্লাশি করা হয়। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বিমানবন্দরের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো সন্ত্রাস ও স্মাগলিং। বিশেষ করে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জঙ্গি হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এত কিছুর পরও বিমানবন্দরে আগমনী বিভাগে স্ক্যানিংয়ের ব্যাপারে চরম দুর্বলতার বিষয়টি এখনো অস্পষ্ট। এখনো একটি স্ক্যানারের ওপরই নির্ভরশীল যাত্রী আগমনী বিভাগ। এ ছাড়াও আমাদের বিমানবন্দরের কর্মীদের প্রশিক্ষণের অনেক দুর্বলতা রয়েছে।’ শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক মঈনুল খান বিমানবন্দরে আগমনী বিভাগে স্ক্যানিংয়ের বিষয়ে বলেন, একাধিক মেশিন থাকলে সার্ভিস দ্রুত দেওয়া যায়। বহির্গমনের স্ক্যানিং ও আগমনীর স্ক্যানিংয়ের কাজ এক নয়। বহির্গমনে স্ক্যানিং করা হয় সম্পূর্ণ নিরাপত্তার কারণে। আগমনী লাউঞ্জে স্ক্যানিং সাধারণত প্রতিটি যাত্রীকে করা হয় না। নির্দিষ্ট কিছু ফ্লাইটের প্রায় প্রতিটি যাত্রীর মালামালই স্ক্যানিংয়ের আওতায় নেওয়া হয়। আবার ইউরোপ থেকে আসা ফ্লাইটের কোনো যাত্রীর মালামাল স্ক্যানিং করা হয় না। তবে কোনো তথ্য থাকলে ইউরোপের ফ্লাইটের যাত্রীর মালামালও স্ক্যানিং করা হয়। তবে একটি স্ক্যানিং মেশিনের স্থানে একাধিক থাকলে দ্রুত সেবা দেওয়া সম্ভব। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের অবশ্যই ভাবনায় নেওয়া উচিত বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা। শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালক (নিরাপত্তা) গ্র“প ক্যাপ্টেন জাকির হাসান বলেন, ‘বর্তমানে নতুন ডি-পাস ইস্যু করা হয়েছে। আর ডি-পাস নিয়ে বাইরে আসার কোনো সুযোগ নেই। অন্যদিকে, এত দিন পুলিশ ছাড়া অন্যান্য সংস্থাকে বিমানবন্দর নিরাপত্তা পাস দেওয়া হলেও খুব শীঘ্রই এ বিষয়টির নিরসন হবে বলে আশা করছি। এ কার্ডটি নকল করার সুযোগ নেই। কারণ এতে বিশেষ হলোগ্রাম দেওয়া আছে।’
বিমানবন্দর এপিবিএনের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন বলেন, ‘বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। এপিবিএন পুলিশ দায়িত্ব নেওয়ার পর বিমানবন্দরের পরিবেশ বিষয়ে আমরা অনেক প্রশংসা পাচ্ছি। তবে কর্তৃপক্ষ চাইলে এপিবিএন আরও দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। যে কোনো ক্রাইসিস মুহূর্তে কাজ করার জন্য এপিবিএনের সদস্যরা সবসময় প্রস্তুত রয়েছে।’
কার্গো ভিলেজের চুরির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কার্গো ভিলেজে চুরির ঘটনাস্থল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। তাদের নিরাপত্তা বিভাগ এর দেখভাল করে। এ ছাড়া বিমানবন্দর এলাকায় অপরাধ করে কেউ পার পাচ্ছে না। অপরাধ করার সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে বিমানবন্দরে প্রায় ১ হাজার কেজি চোরাই সোনা ধরা পড়েছে। ২০০৯ সালে পৌনে ১২ কেজি, ২০১০ সালে ৯ কেজি, ২০১১ সালে ৪ কেজি, ২০১২ সালে ২৪ কেজি ও ২০১৩ সালে ৫৫০ কেজি সোনা আটক করা হয়েছে। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত অর্ধশতাধিক চালানে প্রায় ৩৫০ কেজি সোনা আটক করা হয়। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশ থেকে ২ হাজার কেজির বেশি সোনা উদ্ধার হয়েছে। গত বছর ২৪ জুলাই শাহজালাল বিমানবন্দরে কাঠমান্ডুফেরত বাংলাদেশ বিমানের একটি উড়োজাহাজের কার্গো চেম্বারে বিশেষভাবে রাখা অবস্থায় ১২৪ কেজি সোনার চালান ধরা পড়ে। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, ওই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।

সর্বশেষ খবর