বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

অব্যবস্থাপনা ও সংকটে জর্জরিত নার্সিং শিক্ষা

দেশের নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চলছে নানা সংকট ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে। নার্সিং কলেজগুলোতে রয়েছে মারাত্মক শিক্ষক সংকট ও হোস্টেলে সিট বরাদ্দে অনিয়ম। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের নার্সিং শিক্ষা এখনো প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে। অব্যবস্থাপনার কারণে নার্সিং কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যদিকে হাসপাতালগুলোতে নার্সের সংখ্যা কম হওয়ায় রোগীর চাপে শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞ নার্সদের কাছ থেকে ব্যবহারিক শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন না। সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের দ্বারা শিক্ষানবিস নার্সদের বেশ কয়েকবার লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। এতে নার্স ও চিকিৎসকের মধ্যকার সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
হোস্টেলে সিট বরাদ্দে অনিয়ম, শিক্ষার্থীকে মারপিট এবং বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার অভিযোগে কলেজের প্রিন্সিপাল ও হাউস কিপারের পদত্যাগ দাবি করে গত ২৭ অক্টোবর আন্দোলনে নামেন ময়মনসিংহের বিএসসি ইন নার্সিং কোর্সের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের মুখে সেদিনই ময়মনসিংহ নার্সিং কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যে কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই শিক্ষার্থীরা হল ত্যাগ করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কঠোর অবস্থানে ২৭ অক্টোবর বিকালের মধ্যে হল ত্যাগ না করায় পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এতে ১৫ শিক্ষার্থী আহত হন। এর আগে নার্সিং কোর্স শেষে এক বছর মেয়াদি ইন্টার্নশিপ কোর্স চালু, বৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করে মাথাপিছু ৩ হাজার টাকায় উন্নীত করা ও নার্সিং কোর্স শেষে মাস্টার্স কোর্স চালুসহ উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন দাবি বাস্তবায়ন করতে একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা গত বছর আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেন। চলতি বছরের মে মাসে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্ন নার্সদের ওপর ইন্টার্ন চিকিৎসকদের হামলার প্রতিবাদে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ইন্টার্ন নার্সরা বিক্ষোভ করেন। এ ঘটনায় ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও বরিশালে রাজপথে নেমে ইন্টার্ন নার্সরা বিক্ষোভ করেন। সে সময় রাতে দায়িত্ব পালনের সময় হাসপাতালের চতুর্থ তলার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে শিক্ষানবিস চিকিৎসকরা শিক্ষানবিস নার্সদের ওপর হামলা চালান। এ হামলায় পলয় কুমার নামের এক শিক্ষানবিস ব্রাদার গুরুতর আহত হন। এ ছাড়া হামলায় আহত হন আর ৫ শিক্ষার্থী। এতে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসক ও ইন্টার্ন নার্সদের মধ্যে বাগবিতণ্ডাও হয়। এ ঘটনায় পর সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সদস্যরা ইন্টার্ন নার্সদের ‘মানসিকভাবে অসুস্থ ও ‘পেশায় অযোগ্য’ বলে মন্তব্য করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডিপ্লোমা নার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আনিসুর রহমান বলেন, সারা দেশে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা গত কয়েক মাসে বেশ অবাধ্য আচরণ করেছেন। এর আগে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা রোগী, তার আত্মীয় ও সাংবাদিকদের পিটিয়েছেন। এবার ইন্টার্ন নার্সদের ওপর চড়াও হচ্ছে। আমরা এসব ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সনদপত্র বাতিল করার দাবি জানাচ্ছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, নার্সিং শিক্ষা প্রদানের জন্য দেশে রয়েছে ৪৩টি নার্সিং ইনস্টিটিউট, ৭টি নার্সিং কলেজ, ৪টি পোস্ট বেসিক নার্সিং কলেজ, ৪টি বিভাগীয় কন্টিনিউইং নার্সিং এডুকেশন সেন্টার ও ২টি পল্লী নার্সিং শিক্ষা কেন্দ্র। নার্সদের শিক্ষার জন্য রয়েছে ৩ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন নার্সিং অ্যান্ড মিডিয়ফেরি সায়েন্স এবং ৪ বছর মেয়াদি বিএসসি ইন নার্সিং। দেশে ডিপ্লোমা নার্সদের জন্য রয়েছে ৩৮টি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ১৭টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বিএসসি কোর্সের জন্য রয়েছে ৭টি কলেজ। প্রতি বছর ডিপ্লোমা কলেজগুলো থেকে প্রায় হাজারখানেক শিক্ষার্থী বের হচ্ছেন। আগে পোস্ট বেসিক বিএসসি শিক্ষা থাকলেও ২০০৮ সালে  বেসিক বিএসসি কলেজের শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও বরিশালে বেসিক বিএসসি কলেজের শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। অন্যদিকে রূপান্তরিত নার্সিং কলেজ বা বেসিক বিএসসি কলেজ চালু করা হলেও এখন পর্যন্ত প্রস্তাবিত পদ তৈরি করা হয়নি। এতে নার্সিং শিক্ষায় শিক্ষক সংকট তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন, স্নাতকোত্তর নার্সিং শিক্ষার জন্য একটি উচ্চতর ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালগুলোতে আরও ১০ হাজার নার্স নিয়োগ দেওয়া হবে।
অন্যদিকে হাসপাতাল থেকে উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত নার্সদের প্রেষণে নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসায় হাসপাতালগুলোতে নার্সের ঘাটতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা নার্সিং কলেজ সূত্রে জানা যায়, তাদের কলেজে তো বটেই অন্যান্য বিভাগীয় শহর বা জেলাগুলোতে  শিক্ষক স্বল্পতা আরও বেশি। সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের নার্সিং শিক্ষাকার্যক্রম আন্তর্জাতিক মানের হলেও পেশাগতভাবে এখনো অগ্রগতি হয়নি। এর উন্নতিতে সময়ের প্রয়োজন। জানা যায়, নার্সিং পরীক্ষা মোট বরাদ্দকৃত আসনের মধ্যে ১০% আসন বরাদ্দ করা হয় ছেলে শিক্ষার্থীদের তথা ব্রাদারদের জন্য। নার্সিং কলেজগুলোর শিক্ষকরা মনে করেন, ভালো নার্স হতে হলে শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে হাতেকলমে ব্যবহারিক শিক্ষার প্রয়োজন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সে সুযোগ পাচ্ছেন না। হাসপাতালগুলোতে নার্সের সংখ্যা কম হওয়ায় রোগীর চাপে শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞ নার্সদের থেকে কিছু শিক্ষা নিতে পারছেন না। অন্যদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্সরা জানান, নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে এক দিন হাসপাতালে তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে এসে শিক্ষা গ্রহণ করছেন। তবে তা পরিপূর্ণ শিক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। এদিকে সরকারি হাসপাতালগুলোতে এখনো বিশেষায়িত নার্সদের জন্য কোনো পদ তৈরি হয়নি। ফলে চিকিৎসায় আন্তর্জাতিক মানের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। জানা যায়, নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষায়িত নার্স গড়ে তোলার জন্য কারকিুলামে শীঘ্রই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর