শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

প্রতারণার ১২ রূপ

নিত্যনতুন কৌশল আছে নারী অপরাধী চক্রও

প্রতারণার ১২ রূপ

বারো রকম অপরাধের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে জনজীবন। ঘর থেকে বেরুলেই পদে পদে বিপদ। তৎপর আছে অপরাধীরা, ওতপেতে থাকে প্রতারকচক্র। তাদের অভিনব সব কৌশলের কাছে সাধারণ মানুষ ধরাশায়ী হন, সব খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। ঘরে ঘরে অনলাইন-ইন্টারনেটের সংযোগে যতই আধুনিকতার ছাপ ছড়াচ্ছে, ততই যেন আটকে পড়ছে প্রযুক্তিনির্ভর নানা অপরাধের বেড়াজালে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকও এখন অপরাধ প্রতারণার অন্যতম হাতিয়ারে পরিণত হয়ে উঠেছে। ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিস্টে নাম যোগ করা থেকে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি, প্রেম গড়ে তোলা এবং সবশেষে প্রতারণার মাধ্যমে সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার বেশকিছু ঘটনায় সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
ঘর থেকে দু-পা ফেলতেই হরেক প্রতারণার বেড়াজালে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মানুষজন। রাস্তায়, বাজারে, কর্মস্থলসহ সর্বত্রই কত রকমের ফাঁদ, মওকায় যে লোকজনের পকেট খালি হয়, তার ইয়ত্তা নেই। অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েও নিস্তার মিলছে না, অনেক ক্ষেত্রে জীবনটাও হারাতে হচ্ছে। অন্যান্য ‘অপরাধ প্রতারণাও’ ইদানীং ডিজিটাল রূপ পেতে শুরু করেছে। এখন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে যেমন অন্যের অ্যাকাউন্ট খালি করা হচ্ছে, তেমনি গলাকাটা পাসপোর্ট তৈরি, বিদেশি ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট ও নিয়োগপত্র প্রস্তুত করলেও সহজে তা জাল প্রমাণের উপায় থাকে না। জাল টাকার ছড়াছড়ি তো আছে বাজারজুড়ে।
বিভিন্ন ম্যারেজ মিডিয়ার সহযোগিতায় প্রতারণার ফাঁদ এখনো চলছে বহাল তবিয়তে। সুন্দরী নারীদের সঙ্গে নিয়ে ম্যারেজ মিডিয়ার ছদ্মাবরণে গড়ে তোলা প্রতারক চক্রের মূল টার্গেট হচ্ছে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী এবং সরকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত পর্যায়ের লোকজন প্রতারণার শিকার হলে অনেকেই সামাজিক সম্মানের কারণে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চান না। ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রতিনিয়তই ছড়ানো হচ্ছে নানা বিকৃত ছবি, পর্নোগ্রাফি আর যত অরুচিকর ভার্চ্যুয়াল সামগ্রী, চলছে আরও নানা রকম প্রতারণা, অপরাধকর্ম। প্রায়ই সংবাদ মাধ্যমে ইন্টারনেটকেন্দ্রিক প্রতারণা ও অপরাধের খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টরাই বলছেন, এ সংক্রান্ত অপরাধের মাত্রা আরও বেশি, অনেক অপরাধের খবরই সংবাদ মাধ্যমে আসে না। মান-সম্মানের ভয়ে অনেকে এরকম অপরাধের শিকার হয়েও থানা-পুলিশ কিংবা অন্য কোনো সংস্থার কাছে অভিযোগ করছেন না। যেগুলো অভিযোগ আকারে আসছে, অনেক ক্ষেত্রে সেসব অপরাধীকে শনাক্তও করা যায় না। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে অনলাইন বা সাইবার ক্রাইম থেকে ভুক্তভোগীদের রক্ষা করা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। কোনো তরুণীর সঙ্গে প্রেম-ঘনিষ্ঠতার একটি মুহূর্তের আপত্তিকর ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হলো সর্বত্র। সামাজিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত ভুক্তভোগী তরুণী থানা-পুলিশ করেও নিস্তার পান না।  সাইবার ক্রিমিনালদের ধরতে ইন্টারনেট প্রটোকল মনিটরিং যন্ত্র আমদানি করছে পুলিশ। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, ইন্টারনেট প্রটোকল মনিটরিং যন্ত্রটি জার্মানে তৈরি। এ যন্ত্রের দাম পড়বে প্রায় ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকা। গোয়েন্দারা জানান, আইপি মনিটরিং যন্ত্রের মাধ্যমে দেশে ও দেশের বাইরে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী ও বিভিন্ন অপরাধীদের যোগাযোগ সহজেই ধরা পড়বে। এতে অপরাধীদের গতিবিধি খুব সহজেই জানা যাবে।
নিত্য-নতুন অপরাধের ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে বেড়েই চলেছে। নানা প্রলোভনে নতুন কৌশলে অপহরণ-মুক্তিপণ আদায় ও ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটাচ্ছে দুর্ধর্ষ নারী অপরাধী চক্র। কখনো কখনো গায়ে পড়েই কারও সঙ্গে বিবাদ সৃষ্টি করছে, ‘কু’ প্রস্তাব দেওয়ার মিথ্যা কথা বলেও পথেঘাটে জিম্মি করে টাকা আদায় করছে এ চক্রের সদস্যরা। চক্রগুলো উত্তরা, গুলশান, ধানমণ্ডি ও বারিধারার মতো অভিজাত এলাকায় সক্রিয়। চন্দ্রিমা উদ্যান, শ্যামলীর শিশুমেলা, মিরপুর চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড, শাহবাগের শহীদ জিয়া শিশুপার্ক, রমনা পার্ক, গুলিস্তান, মতিঝিলসহ আরও কিছু স্থানে এসব নারী অপরাধী সিন্ডিকেটের তৎপরতা রয়েছে। টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে কৌশলে বাসা কিংবা নির্জন স্থানে নিয়ে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। এ ধরনের কয়েকটি চক্রকে ডিবি গ্রেফতার করলেও তাদের দৌরাত্ম্য পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না।
ব্যাংকিং সেক্টরেও অভিনব সব অপরাধ ঘটে চলছে অহরহ। গুলশান-বনানীতে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে যে কারও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দেওয়ার সংঘবদ্ধ চক্র তৎপর রয়েছে। তারা কারও অ্যাকাউন্টের একটি চেক পেলে একই আদলের ও স্বাক্ষরের শত শত চেক তৈরি করতে সক্ষম। সেই চেক ব্যবহার করে টাকা উত্তোলনসহ নানা রকম প্রতারণার ফাঁদ পাতলেও কারও কিছু করার থাকছে না।
ভুক্তভোগী সাইফুল ইসলাম নামক এক ব্যক্তির অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, বিগত ২৩ জানুয়ারি তার ব্র্যাক ব্যাংক অ্যাকাউন্টের (নং-১১০২১৮৩২৪৪০০১) বিপরীতে জাল চেক সৃজন (নং-৯২০৭২৪৫) করার মাধ্যমে অভিনব কৌশলে মোটা অঙ্কের টাকা উত্তোলন করে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় গুলশান থানায় মামলা নং-০২(০৩)১৪ ইং রুজু হলে পুলিশ ব্যাংকের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সূত্রে প্রতারকচক্রের কয়েকজনকে গ্রেফতার করতেও সক্ষম হয়। কিন্তু এরপরই অজ্ঞাত কারণে পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সংঘবদ্ধ এই ব্যাংক প্রতারকদের জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে বড় রকম জালিয়াতচক্রের অপরাধ প্রতারণা উদ্ঘাটন সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় সবকিছু চাপা পড়ে থাকার অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি একটি ব্যাংক জালিয়াতি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সন্ধান পায় এক শরীফের। তার নেতৃত্বে প্রতারক মতিন, দিদার, আলাউদ্দিন, মুসলিম, খুরশিদের সমন্বয়ে গড়েওঠা অপরাধ সাম্রাজ্যের তথ্যও বেরিয়ে আসে দুদকের তদন্তে। প্রতারক সর্দার শরীফ কখনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কখনো স্বনামধন্য ব্যবসায়ী, কখনো শিল্পোদ্যোক্তা, কখনো আবার বিশ্বস্ত প্রেমিক, স্বামী, র‌্যাব, ডিবি, সিআইডি কর্মকর্তা। যেখানে যেমন প্রয়োজন সে পরিচয়ই ধারণ করেন শরীফুল ইসলাম শরীফ। স্বাক্ষর জালিয়াতি, সনদ জাল, ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া তার কাছে মামুলি ব্যাপার। অভিনব পদ্ধতিতে এরই মধ্যে তিনি অনেক ব্যক্তি এবং ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে রাজধানীসহ সারা দেশে রয়েছে এক ডজনের বেশি প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের মামলা। সাধারণ ডায়েরি রয়েছে ২২টি। বিচারাধীন রয়েছে অস্ত্র মামলাসহ চারটি মামলা। এতসব মামলা, জিডি মাথায় নিয়েও শরীফ তার সিন্ডিকেট সদস্যদের নিয়ে দেশজুড়ে প্রতারণামূলক কাজ কারবার বহাল তবিয়তেই চালিয়ে যাচ্ছেন।
জীবনের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে প্রতারণা। গত ৩ সেপ্টেম্বর মাগুরার মহম্মদপুরে মালেকা পারভীন নামের এক শিক্ষিকা অভিনব প্রতারণার শিকার হন। তার মোবাইল ফোনে ০১৭৭০-৪৫৬৩৯৮ নম্বর থেকে একটি কল আসে। অপরিচিত এক ব্যক্তি তাকে বলে লটারিতে আপনি ৭৫ লাখ টাকা পেয়েছেন। নানা ছল-চাতুরির এক পর্যায়ে ওই নম্বরে ৫৭ হাজার টাকা বিকাশ করেন মালেকা। পরে আর ওই নম্বরে কল করে কাউকে পাননি। বিষয়টি নিয়ে মহম্মদপুর থানায় জিডি করা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি পুলিশ ওই প্রতারকের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। মোবাইল ফোনে লাখ লাখ টাকা লটারি পাওয়ার প্রলোভনযুক্ত ম্যাসেজ বানিয়ে এমন প্রতারণা করা হচ্ছে অহরহ। গভীর রাতে জিনের বাদশা সেজে মোবাইল ফোনে কল দিয়ে নাঁকি সুরে কথা বলা হয়, বলে দেওয়া হয় অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। মোটা অঙ্কের সেলামি দাবি করে বলে দেওয়া হয়, জিনের বাদশাকে খুশি করলে আপনার বাড়িতেই মাটির নিচে থাকা গুপ্তধনের সন্ধান দেবেন জিন বাবা। চাহিদামতো সেলামি আর গুপ্তধন উঠানোর খরচ হাতিয়ে নিয়েই নিরুদ্দেশ হয়ে যান কথিত জিনের বাদশা।
চলতি পথের পদে পদে প্রতারণামূলক অপরাধের বেড়াজাল, ঘরে বসে থেকেও রেহাই নেই। হরেক কৌশলের ফাঁদে সঞ্চয়ের টাকা তুলে দিতে হচ্ছে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসায়ী ও মাল্টিপারপাসের বাণিজ্য ফেঁদে বসা প্রতারকদের হাতে। হুন্ডি কাজলের চেয়েও ধূর্ত প্রতারকরা দ্বিগুণ, তিনগুণ লাভের লোভ দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে মানুষের সর্বস্ব। অল্প বিনিয়োগে অসম্ভব পরিমাণ লাভ করার দুর্বিনীত লোভে অনেকেই ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়ি, এলসিডি টিভিসহ আরও কত কি পেয়ে যায় অনায়াসে। আর প্রান্তিক বিনিয়োগকারীরা সর্বস্ব খুইয়ে হায়! হায়! করে উঠেন। ইউনিপেটুইউ নামে ভূইফোঁড় একটি এমএলএম কোম্পানির নামেও দেশ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হলো ১৫ হাজার কোটি টাকা। ডেসটিনির প্রতারণার হিসাব-নিকাশ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে তা কয়েক লাখ কোটি টাকার প্রতারণা হিসেবে চিহ্নিত করছেন ভুক্তভোগীরা।
নূরেরচালা ও খিলবাড়ীর টেক মহল্লার কয়েকটি চিহ্নিত বাড়িতে একদল প্রতারক তরুণী বসিয়েছে নিত্য প্রতারণার আসর। তাদের পেছনে স্থানীয় থানার দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশের নেপথ্য সহায়তাও রয়েছে। প্রতারণার আস্তানায় পুলিশের সিভিল টিম পরিচয়ে দফায় দফায় সাজানো অভিযান চালিয়ে কথিত খদ্দেরদের টাকা-পয়সা, মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়া হয়। গোলাম সারওয়ার পিন্টু নামে আরেকজন বহুরূপী প্রতারকের সন্ধান পাওয়া গেছে। উত্তর বাড্ডায় রীতিমতো সাজানো গোছানো অফিস বানিয়ে বসেছেন তিনি। এসটিভির পরিচালক পরিচয় দিয়ে দেশজুড়ে সাংবাদিক কার্ড বিতরণসহ নানারকম ধান্দাবাজির কার্যক্রম চলে সেখানে। ভাড়া করে নেওয়া মাইক্রোবাসে আইন-আদালত লেখা ব্যানার লাগিয়ে ব্যুম হাতে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে হরদম অপকর্ম করে বেড়ায় চক্রটি। চ্যানেল ফাইভের পরিচয়পত্র আর স্টিকার লাগিয়ে একদল অপরাধী সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইলে বিমানের তেল চুরির ব্যবসার ফাঁদ পেতে বসেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর