শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

সিরিজ অপরাধে পুলিশ

* সদর দফতরে অভিযোগের স্তূপ * এসপিদের কাছে সতর্ক বার্তা

সিরিজ অপরাধে পুলিশ

মিরপুরের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপহৃত ছাত্র শফিকুল ইসলামের কফিনবন্দী লাশ উদ্ধার হয় সাভারের জয়েনবাড়ির মকবুল মার্কেটের পেছনের একটি পরিত্যক্ত কক্ষ থেকে। এর আগে বনানী এলাকায় অপহরণকারীদের দেওয়া হয় মুক্তিপণের ২০ লাখ টাকা। অপহরণ ও পরে হত্যার পুরো পরিকল্পনায় ছিলেন কাফরুল থানার এসআই মনিরুজ্জামান। পুলিশি তদন্তে এমন তথ্য বেরিয়ে এলে থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী এবং এসআই মনিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
মোহাম্মদপুরে বাসা থেকে ডেকে এনে ব্যবসায়ী শাহআলমকে সরকারি পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করেন শেরেবাংলানগর থানার এসআই আনোয়ার হোসেন। শাহআলমের স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্ক নির্বিঘ্ন রাখতেই এ কাণ্ড ঘটান এসআই আনোয়ার। গত সপ্তাহে এ ঘটনা ঘটার পর আনোয়ারকে গ্রেফতার করা হয়। অবৈধ অস্ত্র বেচাকেনার সময় উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকা থেকে হাতেনাতে গ্রেফতার হন পুলিশের বিশেষ শাখার এসআই আসাদ। থানাতেই ইয়াবা আর ফেনসিডিল ব্যবসা করতে গিয়ে ধরা পড়েন মিরপুর ও তুরাগ থানার দুই কনস্টেবল। দেড় লাখ টাকার জন্য থানায় ধরে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন মিরপুর থানার এসআই জাহিদ। জাহিদ এখন কারাগারে।
মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাদের দায়িত্ব, সেই পুলিশই এখন মানুষের নিরাপত্তা ভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুন, অপহরণ, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি এবং নারী কেলেঙ্কারির মতো ভয়ঙ্কর সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে পুলিশ। অর্থের জন্য সাজানো মামলায় যাকে-তাকে হয়রানি ও থানায় এনে নির্যাতনের ঘটনাও বেড়েছে। মিথ্যা মামলার আসামি হয়ে অনেকের জীবন এখন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ের অভিযোগও উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। সাম্প্রতিককালে পুলিশের একের পর এক সিরিজ অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।
অপরাধে পুলিশের সংশ্লিষ্টতার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় পুলিশ প্রশাসনকেই ভাবিয়ে তুলেছে। প্রতি মাসে সদর দফতরে এমন সহস্রাধিক অভিযোগ জমা পড়ছে। এ অবস্থায় ফৌজদারি অপরাধে না জড়ানো ও ব্যক্তিগত স্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার না করার ব্যাপারে সারা দেশের পুলিশের সব ইউনিটকে সতর্ক করে বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারদের কাছে পাঠানো ওই বার্তায় পুলিশ সদস্যরা যেন কোনো অপকর্মে লিপ্ত হতে না পারে, সে জন্য নিয়মিত মনিটরিং করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রাইজ পোস্টিং পাওয়া পুলিশ সদস্যদের অধিকাংশই এসব অপরাধে জড়িত। দলীয় পরিচয় থাকায় এরা পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তাদেরও ধার ধারে না। অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না তাদের বিরুদ্ধে। যে কারণে পরবর্তীতে তারা বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের কতিপয় সদস্য অপরাধীর কায়দায় সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় গোটা বাহিনীর ইমেজ সংকটের মধ্যে পড়বে। পুলিশের প্রতি মানুষ আস্থা হারাবে। যা পুনরুদ্ধার করা পুলিশের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এস এম শাহজাহান বলেন, পুলিশকে নিজেদের মতো করে কাজ করতে দিতে হবে। দলীয়করণের কারণে অপরাধের বেশ কিছু ঘটনা ঘটছে, যা পুলিশের কাছ থেকে কেউ আশা করে না। পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার জানান, একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীতে অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। দোষী যে-ই হোক, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। অতীতে বিভিন্ন অপকর্মের দায়ে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, বিগত দুই মাসে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে খুন, ডাকাতি, শ্লীলতাহানি, ছিনতাই, অপহরণসহ নানা অপরাধের আড়াই হাজার অভিযোগ জমা পড়ে। পুলিশের বিরুদ্ধে এর মধ্যে গত ১৪ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী এলাকায় মেজবাহউদ্দিন তারেক নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার পর কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ের অভিযোগ ওঠে ডিবি পুলিশের বিরুদ্ধে। পরে আদালতে ডিবি পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। সিআইডি মামলাটি তদন্ত শুরু করেছে। ৯ অক্টোবর রাজধানীর ভাসানটেক এলাকায় খুনিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে নিহত নাসির উদ্দিনের পরিবারকে হয়রানি করেন সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সদস্যরা। ওই ঘটনায় ওসি, পরিদর্শককে (তদন্ত) প্রত্যাহারসহ ১৯ জনকে প্রত্যাহার এবং সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পুরান ঢাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের অভিযোগে পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা গ্রেফতার হন। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে সাধারণ মানুষকেও চরম হয়রানি করছে পুলিশ। পুলিশের এমন হয়রানির কারণে সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি মেজবাহউদ্দীন শরীফ। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার ছেলে মেজবাহউদ্দীন শরীফ জানান, পরীক্ষার কয়েক দিন আগে মিরপুর থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ভুয়া সার্টিফিকেটে দায়ের করা একটি নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। মামলাটি আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পর তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর থানার এসআই মিজানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় পুলিশ প্রশাসন। তাকে গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ডিসিপ্লিন অ্যান্ড প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড শাখায় অভিযোগের স্তূপ পড়েছে। প্রতি মাসে গড়ে এক হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে যারা শাস্তির আওতায় আসেন, তাদের বেশির ভাগই পুলিশ কনস্টেবল থেকে উপ-পরিদর্শক (এসআই) পর্যন্ত। অভিযোগ রয়েছে, পরিদর্শক থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সংশ্লিষ্টরা প্রভাব বিস্তার করে তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দাবি, অপকর্ম করে পুলিশের ভিতর কেউ পার পাচ্ছে না। বিভিন্ন ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত দুই বছরে অন্তত ২১ হাজার পুলিশ সদস্যকে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্যকে। 

সর্বশেষ খবর