রবিবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

উপকূলে অপহরণ বাণিজ্য

* সুন্দরবনে তৎপর ৩০ বনদস্যু বাহিনী * দস্যুদের ভয়ে নদীতে মাছ ধরছে না নোয়াখালীর জেলেরা

উপকূলে অপহরণ বাণিজ্য

সুন্দরবনের গহিনে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে কয়েকজন জেলে -ফাইল ছবি

সুন্দরবনের রাজা এখন আর রয়েল বেঙ্গল টাইগার নয়, ম্যানগ্রোভ এ বনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বনদস্যুরাই। সুন্দরবনসহ এ উপকূলে ‘রামরাজত্ব’ কায়েম করেছে ৩০টির বেশি দেশি-বিদেশি দস্যু বাহিনী। উপকূলে সুন্দরবনের শেষ সীমানা সাতক্ষীরা জেলার মুন্সীগঞ্জ থেকে খুলনা, বাগেরহাট ছাড়াও নোয়াখালী, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলার উপকূল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৩০টির বেশি বনদস্যু বাহিনী। ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৬৬ জন বনদস্যু নিহত হলেও থেমে নেই তাদের তৎপরতা। মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ, চোরাচালন, বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচারই হচ্ছে এসব বাহিনীর প্রধান কাজ।

বনদস্যু বাহিনীর ১৭টি হচ্ছে বাগেরহাট জেলার। এর শীর্ষে রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কাকদ্বীপে বাগেরহাটের রাজুর নিয়ন্ত্রণাধীন তিনটি বাহিনী। জাহাঙ্গীর, ইলিয়াস ও রফিক বাহিনী প্রধানের বাড়িও বাগেরহাট জেলায়। এই তিন বাহিনী পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ ও পশ্চিম বিভাগের উপকূল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ৬০ থেকে ৭০ জনের এই তিন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলির বিশাল ভাণ্ডার। তারা ব্যবহার করে ফোর সিলিন্ডার পাঁচটি স্পিডবোট ও দ্রুতগতির ছয়টি ট্রলার। শীর্ষ     বাহিনীর প্রধান রেজাউল ওরফে শীর্ষ বন্দুকযুদ্ধে নিহতের পর এখন বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের বেল্লাল, আউয়াল, একই জেলার রামপালের মোশা তিনটি বাহিনী গঠন করে সুন্দরবনে অপহরণ-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। খলিল বাহিনী প্রধান খলিলের বাড়ি বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ভাগায়। একই উপজেলার চাড়াখালী গ্রামে ভাই ভাই বাহিনী প্রধান মোশারেফ ওরফে মোশার বাড়ি। এ ছাড়া বাগেরহাট জেলায় বাড়ি অন্য বনদস্যু বাহিনীগুলো হচ্ছে পুলিশ বাহিনী, ছোট আউয়াল বাহিনী, সোহরাব বাহিনী, কামাল বাহিনী, মালেক বাহিনী, শুকুর-জুম্মান বাহিনী, নয়ন বাহিনী, শরণখোলার বাহিনী প্রধান সমীরের শান্ত বাহিনী ও মংলার তৌহিদ দফাদারের তৌহিদ বাহিনী। খুলনা জেলায় বাড়ি বনদস্যু বাহিনীগুলোর মধ্যে রয়েছে কালু বাহিনী। এই বাহিনীপ্রধান কালুর বাড়ি খুলনার ফুলতলা এলাকায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যদের নিয়ে গঠিত দুর্ধর্ষ মুসা বাহিনী তৎপর পূর্ব সুন্দরবনের বাগেরহাটের চাঁদপাই রেঞ্জ ও পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের দাকোপ-কয়রা এলাকায়। মুসার বাড়ি খুলনা সদরে। এ ছাড়া খুলনা জেলায় বাড়ি অন্য বনদস্যু বাহিনীগুলো হচ্ছে রাঙ্গা মুকুল বাহিনী, বকর-বাবু বাহিনী, আমিনুল বাহিনী। সাতক্ষীরা রেঞ্জসহ সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগের ভারতীয় উপকূলের চালতেবাড়িয়া-হরিনগর এলাকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা আলিফ বাহিনী। জানা গেছে, বাহিনীপ্রধান আলিফের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলায়। এ ছাড়া খোকা-বাবু বাহিনী, রাঙ্গা বাহিনী, জোনাব আলী বাহিনী, আলিম বাহিনী, মজিদ বাহিনী, সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার দুই ভাই চাঁদ মেনকা-খোকার বাবু বাহিনী। সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে তৎপর রয়েছে একটি ভারতীয় বনদস্যু বাহিনী। নিবর বাহিনী নামের এ দলের সদস্যরা সীমান্ত নদী পেরিয়ে এসে মুক্তিপণের দাবিতে সুন্দরবনের জেলে-বনজীবীদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। এসব বাহিনীর রয়েছে দ্রুতগতির জলযান ও অত্যাধুনিকসহ অগ্নেয়াস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার।

প্রকৃতির অপার বিস্ময় সুন্দরবন। এ ম্যানগ্রোভ বন দিনরাত ২৪ ঘণ্টায় ছয়বার তার রূপ বদলায়। বাগেরহাটের শরণখোলা রেঞ্জের কটকা উপকূল থেকে দেখা যায় সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগের চারটি রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত। ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ বনের স্থলভাগ হচ্ছে ৪ হাজার ১৪৩ বর্গ কিলোমিটার। ৪৫০টি নদ-নদী ও খাল নিয়ে জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ বর্গ কিলোমিটার। হাজার হাজার মেট্রিক টন গরান, গোলপাতা, ছন ছাড়াও প্রতিবছর আহরিত হয় ১৬ হাজার মন মধু। এ বনের ওপর ৭৫ হাজার জেলে-মৌয়াল-বনজীবীসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবন-জীবিকা জড়িত উপকূলের ১০ লাখ মানুষের। প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করে। সুন্দরবনের এই বিশাল সম্পদের ভাণ্ডার, বন্যপ্রাণী ও বন বিভাগকে রাজস্ব দিয়ে সুন্দরবনে জীবিকার সন্ধানে আসা জেলে-বনজীবী ও পর্যটকদের মুক্তিপণের দাবিতে আপহরণের র্টাগেট করে নেমে পড়ে বনদস্যু বাহিনীগুলো।

সুন্দরবনসহ উপকূলে বনদস্যুদের হাতে প্রতিনিয়ত মুক্তিপণের দাবিতে জেলে-বনজীবীদের অপহরণের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। উপকূলীয় মৎস্যজীবী সমিতির হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে বনদস্যুরা সুন্দরবনসহ উপকূল থেকে মুক্তিপণের দাবিতে দেড় হাজারের বেশি জেলে-বনজীবী অপহৃত হয়েছেন। অপহৃতদের একটি অংশকে অভিযান চালিয়ে কোস্টগার্ড, র‌্যাব, পুলিশ, ও বনরক্ষীরা উদ্ধার করলেও বড় একটি অংশ দালালের মাধ্যমে মুক্তিপণ দিয়ে বনদস্যুদের হাত থেকে ছাড়া পায়।
উপকূলী মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি শেখ ইদ্রিস আলী জানান, উপকূলের মৎস্য বন্দরগুলোতে বনদস্যুদের এজেন্টদের কাছে নির্ধারিত চাঁদা দিয়ে ‘টোকেন’ না নিয়ে কোনো জেলে বা বনজীবী সুন্দরবনসহ উপকূলে যেতে পারে না। টোকেন না নিয়ে গেলেই বনদস্যুদের হাতে মারধর ও মুক্তিপণের দাবিতে অপহৃত হতে হয়। এটিই হচ্ছে বাস্তব অবস্থা। নিরাপত্তার অভাবে অনেক জেলে-বনজীবী এখন পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে মৎস্য আহরণ, সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব।
এদিকে নোয়াখালীর উপকূলীয় মেঘনা নদীতে মাছ ধরতে গেলে জেলেদের  ওপর দস্যুদের হামলা, অপহরণ, মাছ লুট ট্রলার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। নদীতে এখন মাছের ভরা মৌসুম হলেও জেলেরা জলদস্যু-বনদস্যুদের ভয়ে মেঘনা নদী ও সাগরে মাছ ধরতে ঠিকমতো যেতে পারছেন না। ফলে শত শত জেলে পরিবার অর্ধাহারে অনাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছে। স্বল্পসংখ্যক কোস্টগার্ড ও পুলিশ সদস্য সময়মতো নৌযানের অভাবে দুর্গম অঞ্চলে অভিযানেও যেতে পারেন না। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলেও দস্যুদের সঙ্গে চলে গোলাগুলি।
সম্প্রতি হাতিয়ার মেঘনায় অপহৃত ৩৬ জেলে উদ্ধার করতে গেলে ঠেঙ্গার চরের জলদস্যুদের সঙ্গে পুলিশের গুলিবিনিময় হয়। পরে আত্মরক্ষার্থে পুলিশও ২১ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে।

জেলার উপকূলীয় অঞ্চলের ত্রাস বাসার মাঝি, নিজাম ডাকাত, নাছির কেরানী, কালা বাদশা র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ও অন্তঃকোন্দলে নিহত হওয়ার পর এলাকা কিছুদিন শান্ত ছিল। তবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা ফের সংঘবদ্ধ হয়েছে। কার্যত  সন্ত্রাসীরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে হাতিয়ার রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী এক নেতা। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এ নেতাকে দস্যুরা চাঁদার ভাগ দিয়ে আসছে। তারা একের পর এক চাঁদার দাবিতে অপহরণ, হামলা, মাছ লুট করে নিয়ে যায়। সম্প্রতি জেলেরা বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরে আসার পথে নিঝুম দ্বীপের কাছে পৌঁছলে জলদস্যুরা মাছ লুট করে নিয়ে যায়। এ সময় দস্যুরা এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে  চার জেলে গুলিবিদ্ধসহ ১২ জেলে ও মাঝি আহত হন। গুলিবিদ্ধ ইসমাইল (৪০), শাখাওয়াত (৩৫), আ. মতিন (৩৮) ও কবির উদ্দিনকে (৪০) হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। এর আগে ২৪ জুলাই ভোরে  মেঘনা নদীর টেঙ্গার চরে চাঁদার দাবিতে ১২ জন জেলেকে দুটি মাছধরা ট্রলারসহ অপহরণ করে নিয়ে যায় দস্যুরা। মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. ইসমাইল ও সাবেক সভাপতি সাহেদ জানান, ট্রলার ও জেলেদের অপহরণ করেছে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার ভুট্টু ডাকাত বাহিনী ও তার সদস্যরা। ট্রলারগুলোর মালিক শাহাদাত ও নিজাম মাঝি। পরে  প্রত্যেক জেলের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে মুক্তিপণ দাবি করে দস্যুরা। এর মধ্যে নুরুল হক মাঝি, আলাউদ্দিন মাঝি, রহমান মাঝিসহ পাঁচজনকে উদ্ধার করা হয়েছে। আর দুজনকে উদ্ধারে মুক্তিপণ দিতে হয়েছে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নোয়াখালীর পুলিশ সুপার মো. ইলিয়াছ শরীফ বলেন, উপকূলীয় এলাকায় দস্যুদের বিরুদ্ধে পুলিশ সব সময় সোচ্চার। তবে নৌযানের যথেষ্ট সংকট রয়েছে। জেলে ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে দস্যুদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর