বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

বিদেশের কারাগারে আট হাজার বাংলাদেশি

ফাঁসির আসামি ৩৪ জন

বিদেশের কারাগারে আট হাজার বাংলাদেশি

ভাগ্যান্বেষী বাংলাদেশিরাই শুধু বিশ্বের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই, দুনিয়াজুড়ে থাকা কারাগারগুলোয়ও জড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের নাম। ৪২টি দেশের কারাগারে কমপক্ষে ৮ হাজার বাংলাদেশি বন্দী বা আটক রয়েছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ খুন-ধর্ষণসহ অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে, আর বেশির ভাগই বৈধ কাগজপত্র ছাড়া অনুপ্রবেশের দায়ে বন্দী বা আটক রয়েছেন। এদের অধিকাংশের পাসপোর্ট না থাকায় বিদেশে দূতাবাস ও দেশের সরকারের কাছে খবরও নেই। তবে এ ক্ষেত্রে হতভাগাদের উদ্ধারে গতি শ্লথ হলেও চেষ্টা ও উদ্যোগ উভয়ই আছে সরকারের। নাম-পরিচয় নিশ্চিত হয়ে দ্বিপক্ষীয় বোঝাপড়ার মাধ্যমে ২৩ দেশে বন্দী থাকা বাংলাদেশিদের ধাপে ধাপে আইনি সেবা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তবে বাকি দেশগুলোয় থাকা আটক ব্যক্তিরা আসলেই হতভাগা। একে তো তারা প্রতারিত হয়ে বা পরিস্থিতি না বুঝে পাচারের শিকার হয়েছেন, এখন ধুঁকে ধুঁকে মরছেন বিদেশের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির কাছে জাতীয় সংসদে দুই দফায় জানতে চাওয়া হয়েছিল বিদেশে বন্দী বাংলাদেশির সংখ্যা। তখন সব দূতাবাস থেকে তথ্য সমন্বয় করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতীয় সংসদকে জানান, অভিবাসন আইন লঙ্ঘন ও ফৌজদারি অপরাধজনিত শাস্তিভোগের কারণে ৪২টিরও বেশি দেশের কারাগারে ৭ হাজার ৮৫৯ জন বাংলাদেশি নাগরিক আটক আছেন। এর মধ্যে মালয়েশিয়ার কারাগারে সবচেয়ে বেশি, ১ হাজার ৯০০ এবং ভারতে ১ হাজার ৮০০ বন্দী রয়েছেন।  

এ ছাড়া সৌদি আরবে ১ হাজার ৪৬, গ্রিসে ৩১১, আমিরাতে ৩০৮, মিয়ানমারে ২৯৯, দক্ষিণ আফ্রিকায় ২৬০, যুক্তরাজ্যে ২৪৪, কুয়েতে ২২০, ওমানে ১৮৮, যুক্তরাষ্ট্রে ১০৭, লিবিয়ায় ৬৭ ও পাকিস্তানে ১৩ জন আটক রয়েছেন। অন্যদিকে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংরক্ষিত তথ্যে দেখা যায়, অনুপ্রবেশের বাইরে অপরাধে জড়িয়ে কারাগারে আটক বা বন্দী আছেন ২৩ দেশে ৪ হাজার ৫৪৬ জন বাংলাদেশি। তারা চুরি, ডাকাতি, মাদক পাচারের মতো অপরাধে অভিযুক্ত বা দণ্ডিত। এর মধ্যে সৌদি আরবে ১ হাজার ২৫৫, মালয়েশিয়ায় ১ হাজার ৯০, আরব আমিরাতে ৯৪৭, ওমানে ১৪৩, সিঙ্গাপুরে ৯০, ইরাকে ৮৮, মালদ্বীপে ৫২, হংকংয়ে ৩৮, ইতালিতে ৩৫, গ্রিসে ৩৫, কাতারে ২৩, তুরস্কে ৫, ব্রুনাইয়ে ৪, আজারবাইজানে ২ ও জর্জিয়ায় ২ জন। অনুপ্রবেশজনিত অপরাধে দণ্ডিত হয়ে কারাবন্দী বাংলাদেশিদের তালিকায় পরে আরও যুক্ত হন অস্ট্রেলিয়ায় ২৪১, ইতালিতে ৮২, চীনে ৭৬, জর্জিয়ায় ৬৩, লেবাননে ৫৫, তুরস্কে ৪৭, বাহরাইনে ৪৬, সার্বিয়ায় ৩৫, মিসরে ২৯, ইরানে ২৬, সুইডেনে ২৫, সাইপ্রাসে ২৪, মালদ্বীপে ২০, জর্ডানে ১৯, নেপালে ১৭, জাপানে ১২, পোল্যান্ডে ১২, আলজেরিয়ায় ৮, জিম্বাবুয়েতে ৮, কোরিয়ায় ৪, তানজানিয়ায় ৪, ইয়েমেনে ৪, নেদারল্যান্ডসে ৪, আজারবাইজানে ৩, ব্রুনাইয়ে ৩, বেলজিয়ামে ৩, ফ্রান্সে ২, কম্বোডিয়ায় ২, মরিশাসে ১, সিরিয়ায় ১ ও বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনায় ১ জন। এর বাইরে আমিরাত, সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমান, মিসর, কাতার, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে খুন-ধর্ষণের মতো অপরাধে ইতিমধ্যে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে কার্যকরের অপেক্ষায় আছেন ৩৪ জন। মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার মতো অপরাধে বিচার চলছে ১৪৮ জনের। অবশ্য প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বললেন, মন্ত্রণালয় বা বিএমইটি বা মিশনের লেবার উইংয়ের সঙ্গে সবাই যোগাযোগ করেছেন তা বলা যাবে না। এর প্রমাণ পাওয়া গেল সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর আমিরাত সফরের সময়। তখন বাংলাদেশের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে উত্থাপিত তথ্যে দেখা গেল, আমিরাতের কারাগারে বাংলাদেশি বন্দির সংখ্যা বেশ আগেই হাজার ছাড়িয়েছে। যেখানে ১১ জনের মৃত্যুদণ্ডের কথা জানা ছিল সেখানে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তই আছেন ১৯ জন। আবার থাইল্যান্ডের কারাগার বা ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা কয়েক শ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনতে জোর চেষ্টা অব্যাহত আছে। সবচেয়ে বেশি ভারতের কারাগারে থাকা বাংলাদেশির সংখ্যা। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর তথ্যানুসারে শুধু পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কারাগারেই আছেন প্রায় ৫ হাজার বাংলাদেশি। অন্যদিকে, দুর্গম পথে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে আফ্রিকার দেশগুলোয় বন্দী হওয়া অনেকের তথ্যই পাওয়া যায় না। সেখানকার অনেক দেশে নিয়মতান্ত্রিক কারাগারের কাঠামোই নেই। সেখানে হয়তো কোনো ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয় গ্রেফতার হওয়া ভাগ্যান্বেষীদের। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের দূতাবাসে কর্মরত এক কূটনীতিক জানান, আটক বা বন্দী বাংলাদেশির তথ্য জানার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের কনস্যুলার শাখার কোনো এক কর্মকর্তা ওই বাংলাদেশির সঙ্গে কারাগারে সাক্ষাতের অনুমোদন চান। পরে কনস্যুলার অ্যাক্সেসে সাক্ষাতের পাসপোর্ট বা অন্যান্য কাগজপত্র থাকলে পরীক্ষা করা হয়। না থাকলে আটক ব্যক্তির দাবিকৃত তথ্যগুলো সংগ্রহ করে দেশে সেই দাবির সত্যতা নিশ্চিত করা হয়। নাগরিকত্বের প্রমাণ হাতে আসার পর দ্রততম সময়ে তাদের মুক্তি বা সহায়তা দিয়ে থাকে দূতাবাস। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন শাখার এক কর্মকর্তা জানান, ২৩টি দেশে থাকা সাড়ে ৫ হাজার বন্দীকে আইনি সহায়তা দিতে গত জুন থেকেই বিশেষ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।  

ওই দেশগুলোয় থাকা বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে বন্দী বা আটকদের সহায়তা দেওয়া হবে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় এ সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রথম ধাপে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও মালয়েশিয়ায় বন্দীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। সে হিসেবে খণ্ডকালীন আইনজীবীও নিয়োগ করা হয়েছে। মূলত বন্দী বাংলাদেশিদের অপরাধের মাত্রা বুঝে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন মেনেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আটকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। তবে যেসব বন্দী ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অবৈধভাবে বিদেশে থাকার অভিযোগে কারাভোগ করছেন, তাদের দ্রুত মুক্ত করার বিষয়ে জোর তদবির চালাবেন আইনজীবীরা। অবশ্য গত কয়েক বছরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৫ শতাধিক বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এর মধ্যে গত তিন মাসেই থাইল্যান্ড থেকে ফিরেছেন ৩ শতাধিক।

সর্বশেষ খবর