রবিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

চার সংকটে বিএনপি

* নেতাদের মধ্যে সন্দেহ অবিশ্বাস চরমে * অগোছালো সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড
* থিঙ্কট্যাঙ্কারের অভাব * কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে নামেন না কেউ

চার সংকটে বিএনপি

আন্দোলন প্রশ্নে প্রধানত চার সংকটে বিএনপি। প্রথমত, দীর্ঘ আট বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে এখনো সন্দেহ-অবিশ্বাস ও আস্থার সংকট চরমে। দ্বিতীয়ত, কয়েক দফা উদ্যোগ নিয়েও বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি পুনর্গঠন না করায় ‘অগোছালো’ সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড। তৃতীয়ত, আন্দোলন কর্মসূচি প্রণয়ন ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে গতি আনতে একটি ‘যোগ্য’ থিঙ্কট্যাঙ্কারের অভাব দলটিতে। এ ছাড়া আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় নেতাদের রাজপথে অনুপস্থিতিতেও হতাশ মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া না হলে নতুন নির্বাচনের দাবিতে আগামী দিনের সরকারবিরোধী আন্দোলনেও হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন দলের নেতা-কর্মীরা। তবে এর বাইরে আরও বেশকিছু সংকটে বিএনপি ঘুরপাক খাচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র জানায়, প্রধান চার সমস্যাকেই সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রধান অন্তরায় হিসেবে মনে করছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নিজেও। সম্প্রতি তিনি দলের স্থায়ী কমিটি ও নির্বাহী কমিটি থেকে শুরু করে তিন স্তরের ফোরাম বৈঠকেও এ সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের পরামর্শ নিয়েছেন। বিএনপির নীতিনির্ধারক মহলের একাধিক সদস্য ও দলীয় ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলাপকালে তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনের পেছনে প্রধান বাধা হিসেবে উপরোক্ত কারণগুলো চিহ্নিত করেন। একই সঙ্গে অনেকে সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলোকেও জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার পেছনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। বিএনপি নেতারা জানান, ঢাকা মহানগরী বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা ও আন্দোলন কর্মসূচিতে ‘গাঢাকা’ দেওয়ার কারণেও বিএনপিতে হতাশা বিরাজ করছে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে নতুন আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হলেও রাজধানীতে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তৃণমূলের চেয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের এখন ঢাকার প্রতি বেশি নজর দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন মাঠের নেতা-কর্মীরা। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকায় তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে বিএনপির চলমান আন্দোলন কখনো সফল হবে না। সারা দেশের মানুষ যেমন এখন বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে, তেমনি বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা তাকিয়ে আছেন ঢাকার দিকে। তাই বিএনপির নীতিনির্ধারকদের ঢাকার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত। অবশ্য পুলিশি বাধার পাশাপাশি ঢাকায় থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে সরকার নেতা-কর্মীদের কোনো সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি জানান, ‘১৮টি ইউনিয়নসহ থানা ও ওয়ার্ড মিলে ঢাকা শহরে বিএনপির চার শতাধিক সাংগঠনিক ইউনিট রয়েছে। এসব স্থানে আমাদের মিটিং করতে দেওয়া হয় না। এমনকি ওয়ার্ড বা থানা পর্যায়ে কমিটি গঠনের ব্যাপারে ঢাকায় নেতাদের বাসায় ডেকে এনে বসলে সেখান থেকেও পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে তার নিজের বাসা থেকে উপস্থিত নেতা-কর্মীসহ ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। অবশ্য শুক্রবার ২৬ দিন কারাভোগের পর ছাড়া পান আলাল।’ সূত্রমতে, বেশ কয়েক দিন আগে ১৪টি জেলা পুনর্গঠনের জন্য আহ্বায়ক কমিটি হলেও ওইসব সাংগঠনিক জেলায় এখন চরম বিরোধ চলছে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি ভেঙে অল্প কয়েক সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করায় তৃণমূলের বড় একটি অংশ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। এমনকি বিএনপির রাজপথের সাদামাটা কর্মসূচিতেও তারা অংশ না নিয়ে কমিটির বিরুদ্ধে ঝাড়ুমিছিল থেকে শুরু করে নানা ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে সম্প্রতি ছাত্রদলের কমিটি দেওয়ার পরও সংগঠনটিতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। পদবঞ্চিতদের পাশাপাশি কমিটিতে ঠাঁই পাওয়া নেতাদের একটি অংশও নতুন কমিটির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে যাচ্ছে। এ নিয়ে বেকায়দায় বিএনপি। দলের প্রভাবশালী দুই নেতাকে দায়িত্ব দিয়েও ক্ষোভ-বিক্ষোভ থামাতে পারেননি বেগম খালেদা জিয়া।
বিএনপি নেতারা জানান, ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে বিদ্রোহের কারণে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দলসহ অন্য অঙ্গ সহযোগী সংগঠনগুলোর পুনর্গঠন প্রক্রিয়া থমকে গেছে। আবার একসঙ্গে মহানগরী বিএনপির কমিটি দেওয়া হলেও বিদ্রোহের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে জানুয়ারিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামতে গিয়ে হোঁচট খাওয়ার কথাও মাথায় রাখছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। সূত্র জানায়, বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার হওয়া কিংবা জামিন নিয়েও বিএনপি নেতারা একে অন্যকে ‘সরকারি এজেন্ট’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। কোনো মামলায় একজনকে জেলহাজতে পাঠানো হলেও আরেকজনকে জামিনে মুক্তি দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ নিয়ে সিনিয়র নেতারা একে অন্যকে সন্দেহ-অবিশ্বাস করছেন। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত খোদ বেগম খালেদা জিয়াও। তিনি এসব নিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে একাধিকবার কথাও বলেছেন। তবে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। এদিকে বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে ডাক না পড়লে সেখানে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছেন দলের ত্যাগী নেতারা। গুলশান কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও দূরত্ব কাজ করছে। আবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও কোনো সংবাদ সম্মেলন বা কর্মসূচি ছাড়া নেতারা আসা-যাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের কার্যালয় থাকলেও যাতায়াত নেই নেতা-কর্মীদের। অধিকাংশ অঙ্গ সংগঠনের কার্যালয় দিনের পর দিন বন্ধ রয়েছে। আন্দোলনের প্রস্তুতি কিংবা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের কোনো আলামতই অঙ্গ সংগঠনগুলোর বন্ধ অফিস দেখলে মনে হয় না। জানা গেছে, আন্দোলন কর্মসূচি প্রণয়নে বিএনপিতে যোগ্য থিঙ্কট্যাঙ্কারের অভাব রয়েছে। সর্বশেষ দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বেগম জিয়া স্বীকার করেছেন, ৫ জানুয়ারির পর আন্দোলন বন্ধ রাখা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এজন্য তিনি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদেরও বলেছেন, ‘আপনারাও আমাকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারেননি’। এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে একাধিক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ৫ জানুয়ারির আগে ও পরে বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে দলের নেতারা দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারতেন না। ওই সময় আমলানির্ভর কিছু অরাজনৈতিক নেতা বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছেন। তারাও সঠিক কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারেননি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ বলেন, সরকারের কারণে নেতাদের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস তৈরি হয়। বিভিন্ন আন্দোলনে কিংবা মামলার জামিন নিতে গেলে সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব বিভ্রান্তিমূলক কর্মকাণ্ড চালায়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, ‘এখন হয়তো আমাদের পুলিশ সভা-সমাবেশ ও কর্মসূচি পালনের অনুমতি দিচ্ছে না। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালাতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। কিন্তু এমন একদিন আসবে যখন পুলিশ বা কারোর কোনো অনুমতি নেওয়ারও আর প্রয়োজন থাকবে না। পুরো জাতি এখন সেই দিনটিরই অপেক্ষায় আছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর