মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

নৈতিক ফ্যাশনে অনৈতিক মজুরি!

নৈতিক ফ্যাশনে অনৈতিক মজুরি!

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পোশাক পণ্য রপ্তানির স্বপ্ন দেখছেন এই শিল্পের মালিকরা। কিন্তু তারা যখন এ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন, তখন অন্যান্য অনেক শিল্পের চেয়েই এখানে শ্রমিকদের মজুরি কম। যদিও পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বিশেষজ্ঞরা একে দেখছেন, আলোর নিচেই অন্ধকার হিসেবে। তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ড আর রানা প্লাজা ধসের পর ক্রেতারা ‘নৈতিক ফ্যাশনের’ ঝড় তুলেছিলেন। বিশ্বজুড়ে সেই তুমুল শোরগোলের পরও ‘অনৈতিক মজুরিতেই’ সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে শ্রমিকদের। এমন প্রেক্ষাপটে আজ পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানির ঘোষণা দেবে। আশাপ্রদ এই ঘোষণার সঙ্গে অবশ্য শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর কোনো প্রতিশ্রুতি থাকছে না। 

ক্রেতারা আন্তর্জাতিক মানের পণ্য চাইলে, মজুরিও বিশ্বমানের নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও শ্রমিক নেতারা। তারা বলছেন, ক্রেতারা সততার সঙ্গে নৈতিক পোশাক পরতে চান। এই নৈতিক পোশাকের অর্থ হলো, ক্রেতা যে পোশাকটি পরছেন, সেই পোশাকটি যেন সব ধরনের সুশাসন মেনেই তৈরি করা হয়। কারখানার কর্মপরিবেশ নিশ্চিত থেকে শুরু করে শ্রমিকের প্রাপ্য নৈতিক মজুরি যেন সঠিকভাবে পরিশোধ করা হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশি পণ্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন আন্তর্জাতিক পোশাক উৎপাদক প্রতিষ্ঠান হ্যাগার কানাডার সভাপতি ব্রায়েন মেইন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের পোশাক শিল্প গুণগত মানে অনেক উন্নত।’ বিপুল বিনিয়োগের প্রতিশ্র“তি দিয়ে ব্রায়েন মেইন আরও বলেন, ‘নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের অগ্রগতি উল্লেখ করার মতো।’ 

কত পান শ্রমিকরা : পোশাক পণ্য উৎপাদনে জড়িত শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরেই বঞ্চিত। দেশের প্রধান রপ্তানিমুখী এ শিল্পের  শ্রমিকরা ন্যূনতম ৮ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে সোচ্চার। বর্তমানে তা ৫ হাজার ৩০০ টাকা। শ্রমিকদের দাবি, বাজারব্যবস্থা ও জীবনযাপনের ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। অনেক কারখানায় ওই ৫ হাজার ৩০০ টাকা মজুরি দিতেও টালবাহানা ও যথাসময়ে না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে একটি গবেষণায় বলেছে, একজন মেশিন অপারেটর বা হেলপার ৮ ঘণ্টা কাজ করলে ৩২০০ খাদ্য ক্যালোরির প্রয়োজন। আর ২ ঘণ্টা ওভারটাইম করলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪০০ ক্যালোরিতে। সে হিসাবে পরিবারের সব সদস্য দূরের কথা, পোশাক শ্রমিকরা ন্যূনতম যে মজুরি পান তা দিয়ে একজনেরই ন্যূনতম খাদ্য ক্যালোরি চাহিদা পূরণ অসম্ভব। মজুরি নির্ধারণ প্রসঙ্গে শ্রম আইন-২০০৬ এর ১৪১ ধারায় বলা আছে, কোনো সুপারিশ প্রণয়নের সময় মজুরি বোর্ডকে শ্রমিকের জীবনযাপনের ব্যয় ও মান, উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা, উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য, মুদ্রাস্ফীতি, কাজের ধরন, ঝুঁকি ও মান, ব্যবসায়িক সামর্থ্য এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করতে হবে। শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার এক নিবন্ধে দুটি প্রস্তাব দিয়ে বলেছিলেন, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো যৌথভাবে একটি আন্তর্জাতিক ন্যূনতম বেতন স্থির করে দেবে। এই পদ্ধতি হতে হবে কারখানা কমপ্লায়ান্সের একটা অংশ। ড. ইউনূস দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলেছিলেন, পোশাক উৎপাদন যারা করল তারা সবাই মিলে পেল ৫ ডলার। আর বিক্রি করতে গিয়ে যোগ হলো আরও ৩০ ডলার। বিক্রি মূল্যটা সামান্য একটু বাড়ালেই শ্রমিকদের জন্য অনেক কল্যাণমূলক পদক্ষেপ নেওয়া যায় এবং উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের মধ্যেও কিছুটা সঙ্গতি আসে। এই পোশাকের যে মূল্য দর কষাকষির মাধ্যমে চূড়ান্ত হবে তার ভিত্তিতে উৎপাদন চুক্তির যে মূল্যমান দাঁড়াবে তার ওপর ১০ শতাংশ টাকা আন্তর্জাতিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান জমা দেবে আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে গঠিত শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্টে। এটা শুধু শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য। 

শুধু চাপই দিচ্ছেন ক্রেতারা : কারখানার কমপ্লায়েন্স নিয়ে ক্রেতাদের চাপে নাস্তানাবুদ উদ্যোক্তারা। এতে উৎপাদন খরচ কয়েকগুণ বাড়লেও ক্রেতারা নামমাত্রও বাড়াননি ক্রয়মূল্য। বরং বাংলাদেশে ক্রয় আদেশ কমিয়ে প্রতিযোগী দেশগুলোতে যাচ্ছেন অনেকে। পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের চড়া সুদ, গ্যাস-বিদ্যুতের অভাব আর বেতন-ভাতা না পেয়ে শ্রমিক বিক্ষোভ তো আছেই। এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পোশাক শিল্প ঘিরে রয়েছে দেশি-বিদেশি চাপ। ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড-অ্যালান্সের কমপ্লায়েন্স নিয়ে চাহিদার কারণে বিপাকে পড়েছেন মালিকরা। অথচ তারা মূল্য বাড়াতে চান না। এটা তাদের সাংঘর্ষিক অবস্থান।’ বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, ২০০৮ সালে সারা দেশে ওভেন কারখানা ছিল ৫ হাজার ৬০৮টি। আর ২০১৪ সালে তা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৭০টিতে। অর্থাৎ মাত্র ছয় বছরেই বন্ধ হয়েছে ৩ হাজার ৩৮টি কারখানা। অন্যদিকে, নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) তথ্যানুযায়ী, প্রায় এক হাজার কারখানা বন্ধ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ মনে করেন, ‘বাংলাদেশে আজ এক ধরনের পুঁজিবাদী বিকাশ হচ্ছে। এ বিকাশের একই সঙ্গে দুটি রূপ দেখা যায়। একদিকে বাংলাদেশ পৃথিবীতে হয় তো অচিরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক শিল্পের অধিকারী হতে চলেছে। অন্যদিকে, সেই বাংলাদেশের শিল্পেরই মজুরি হচ্ছে বিশ্বের নিম্নতম। এটি আলোর নিচেই অন্ধকার।’
অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স তৎপরতা : শ্রমিকদের নিরাপত্তা ইস্যুতে বিদেশি ক্রেতাদের কারখানা পরিদর্শনের প্রভাবে পোশাক শিল্পে এখনো ছাঁটাই আতঙ্ক রয়েছে। বাংলাদেশি পোশাক পণ্যের ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের তৎপরতায় ইতিমধ্যে ২০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছেন। একই সঙ্গে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি মালিকদের। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ একাধিকবার বলেছেন, ‘অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স আমাদের সবক দিচ্ছে। এখানে গভীর ষড়যন্ত্র আছে। কারখানা বন্ধ হলে শ্রম অসন্তোষ হবে। ইইউভুক্ত দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছে পাকিস্তান। এর অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লবিং কাজ করছে। যাতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়।’

 

সর্বশেষ খবর