বুধবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

ডাক বিভাগ ডুবছে

* বন্ধ হয়ে গেছে টেলিগ্রাম সার্ভিস * ডাক বাক্সগুলোও বিলীন হওয়ার পথে * সবাই মজেছে মোবাইল ও ইন্টারনেটে

ডাক বিভাগ ডুবছে

নাই টেলিফোন, নাই রে পিয়ন, নাইরে টেলিগ্রাম, বন্ধুর কাছে মনের কথা কেমনে পৌঁছাইতাম-বাংলা এ জনপ্রিয় গানের মতোই সরকারি টেলিফোন, ডাকঘরের চিঠি, টেলিগ্রাম সবই হারিয়ে যেতে বসেছে। দুর্নীতি, লুটপাট আর পরিকল্পনাহীনতায় সরকারি টেলিফোন সংস্থাটি বিলুপ্তপ্রায়। নানা প্রতিবন্ধকতায় কয়েক বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে টেলিগ্রাম সার্ভিস। নীল, হলুদসহ নানা রঙের খামের চিঠি আর লাল রঙের সেই ডাকবাক্সও বিলীন হওয়ার পথে।
আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থায়, তথ্য ও প্রযুক্তির থাবায় বন্দী হয়ে আছে একসময়ের জনপ্রিয় যোগাযোগ-মাধ্যম চিঠি, ডাকপিয়ন, ডাকবাক্স ও ডাকঘর। এখন আর আগের মতো কদর নেই প্রতিষ্ঠানটির। প্রিয়জনের খবরাখবর পেতে এখন আর কারও ডাকপিয়নের হাঁকের অপেক্ষা করতে হয় না। চিঠির আশায় ঘুরতে হয় না ডাকপিয়ন থেকে ডাকঘরে। মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের কল্যাণে চিঠির প্রতি কমবেশি সবাই আগ্রহ হারিয়েছে। চিঠিভর্তি ডাকঘরে এখন চিঠির প্রচলন নেই বললেই চলে। দরজা-জানালা বা গলির নাম নয়, ঠিকানা মানেই হয়ে উঠেছে ই-মেইল ঠিকানা।

অথচ এক দশক আগেও চিঠি ছিল পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং একে অপরের মধ্যে মধুর সম্পর্ক গড়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম। ২০০৪ সালেও দেশে ২৩ কোটি চিঠি লেনদেন হয়েছে। আপনজনের চিঠির মমত্ববোধের সঙ্গে প্রিয়জনের চিঠি, ভালো-লাগার মানুষের প্রণয়ের চিঠির যে কত মাধুর্য আর মধুময়তায় নাড়া দিত হৃদয়ের অনুভবে! পুরনো দিনের চিঠি আজও প্রবীণ ও মধ্যবয়সীদের জীবন অধ্যায়ের পাতা হয়ে আছে। একটা সময় ডাকপিয়নেরও কদর ছিল যথেষ্ট। বিশেষ করে প্রেমের চিঠি বিলি করার নানা মজার ঘটনা এখনো অনেকের স্মৃতিতে অমলিন। অনেক ডাকপিয়ন প্রণয়ঘটিত অনেক বিয়ের নীরব সাক্ষী। পিঠে চিঠির বস্তা নিয়ে ঝুনঝুন ঘণ্টা বাজিয়ে রাতের আঁধারে রানার চলত দূরের পথে। ডাকটিকিটের মাধ্যমে সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে পোস্ট অফিসের (ডাকঘর) পালা শুরু হয় ১৮৪০ সালে। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এ ব্যবস্থা। খাম, পোস্টকার্ড, ডাকটিকিট, মানি অর্ডার মিলিয়েই ছিল প্রথম দিককার ডাক বিভাগ। পরবর্তী সময়ে ডাক বিভাগে যুক্ত হয় সরকারের নানা পরিসেবা। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই চিঠি লেখা শিখেছেন মোবাইলের খুদে বার্তা, ইটারনেট চ্যাটিং, ই-মেইলে। কাগজে হাতে লেখা চিঠি তাদের কাছে বিরক্তিকর। নানা অনিশ্চয়তায় এখন সরকারি কাজের চিঠি অনেক সময় বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠানো হচ্ছে। দিন দিন ব্যক্তিগত চিঠি হারিয়ে বর্তমানে তা ১০ ভাগে নেমে এসেছে। তবে চিঠি, বাক্স, বিতরণব্যবস্থা বিলুপ্ত হতে চললেও ডাক বিভাগের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী আর হাজারো অবকাঠামো বহাল তবিয়তেই আছে। এসবের পেছনে ফিবছর কোটি কোটি টাকা সরকারি অর্থের জোগানও আছে যথারীতি।

ডাক বিভাগে ক্রমাগত লোকসান : ক্রমাগত লোকসানের মুখে বেহাল দশা ডাক বিভাগের। ২৭ বছরে ডাক বিভাগ লোকসান দিয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। গত পাঁচ বছরে লোকসান গুনতে হয়েছে ৭৪৪ কোটি টাকারও বেশি। একসময়ের জনগণের যোগাযোগের মাধ্যমটি এখন অনেকটা সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের কারণে অনেকেই এখন আর চিঠি লেখেন না। যারা এখনো কমবেশি চিঠি লেনদেন করেন, ডাক বিভাগের আওতা থেকে প্রায়ই তা হারিয়ে যায়। ২০০২-০৩ অর্থবছর থেকে সাংবাৎসরিক লোকসানের ধকল বেশি মাত্রায় শুরু হয় ডাক বিভাগে। ওই বছর লোকসান ছিল ৮৭ কোটি ৯ লাখ। ২০০৩-০৪ অর্থবছরই লোকসানের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১২৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ২০০৮-০৯ সালে লোকসানের পরিমাণ ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেলেও বর্তমানে বার্ষিক লোকসান দেড়শ কোটি টাকায় এসে ঠেকেছে। সেবার মান দুর্বল হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক মানি অর্ডার নেমে এসেছে অর্ধেকে। আন্তর্জাতিক মানি অর্ডারের প্রায় ৮০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক। অভ্যন্তরীণ মানি অর্ডারের প্রতিযোগিতায়ও টিকতে পারছে না ডাক বিভাগ। পার্সেল কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। স্ট্যাম্প বিক্রির অবস্থাও বেহাল। ইএমটিএস ও পোস্টাল কার্ড বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও নানা কারণে তা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রচার-প্রচারণার অভাবে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ দুটি স্কিমে গ্রাহক বাড়ানো যাচ্ছে না। চালু হচ্ছে না নতুন সুবিধাও। পাসপোর্ট আবেদন চালু হলেও নানা কারণে বিভিন্ন সময় তা বন্ধ থাকছে। বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রের স্কিমগুলো সফল হলেও ইদানীং সঞ্চয়ী হিসাব খুলে অর্থ জমা রাখায় গ্রাহকসংখ্যা কমছে। সুদ কম দেওয়ার কারণেই গ্রাহকসংখ্যা কমছে বলে অনেকে মন্তব্য করেন। ডাকঘরের অন্যান্য সেবা কার্যক্রমের মধ্যে ই-ব্যাংকিং, জীবন বিমা, সাধারণ বিমাসহ সরকারি চিঠিপত্র, পার্সেল ইত্যাদি নানামুখী সুবিধা ও কার্যক্রম চালু আছে। তবে এসব কার্যক্রমের মধ্যে ই-ব্যাংকিং সেবা জনসাধারণ ও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বেশ সাড়া জাগায়। প্রাইভেট ই-ব্যাংকিং সুবিধার তুলনায় ডাকঘরে ই-ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করা অনেকটা ঝামেলা ও ভোগান্তিমুক্ত বলেও মনে করেন গ্রাহকরা।

ডাকঘরের দৈন্যদশা, কর্মচারীদের মানবেতর জীবন : বর্তমানে সারা দেশে মোট পোস্ট অফিসের সংখ্যা ৯ হাজার ৮৮৬টি। এর মধ্যে ৮ হাজার ৭০০ পোস্ট অফিসই গ্রামীণ। দেশে বিভাগীয় (ডিপার্টমেন্টাল) ডাকঘরের সংখ্যা এক হাজার ছয়শর বেশি। গ্রামীণ বা অতিরিক্ত বিভাগীয় (এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল) ডাকঘর রয়েছে আট হাজারের মতো। সব মিলিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ১৭ হাজার। আর ভাতাপ্রাপ্ত লোকবলের সংখ্যা ২৪ হাজারের বেশি। বর্তমানে বেশির ভাগ ডাকঘরের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। কারণ প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও জনবলের অভাবে ভাঙা চেয়ার, টেবিল ও কাঠের বাক্সে, আলমিরায় কোনোমতে চলছে কার্যক্রম। এ ক্ষেত্রে সরকারি আসবাবপত্রের বরাদ্দ হলেও তা উপজেলা ও শাখা পর্যায়ের ডাকঘরসমূহে এসে পৌঁছায় না। ফলে আসবাবপত্রের অভাব দীর্ঘদিন লেগে থাকে। প্রয়োজনীয় আলমিরা না থাকায় অফিসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র যেখানে-সেখানে অরক্ষিতভাবে ফেলে রাখায় তা বিনষ্ট হচ্ছে।

মানবেতর জীবন যাপন : প্রতিটি শাখা ডাকঘরে কর্মচারী রয়েছেন তিনজন করে। এদের মধ্যে একজন ইডিএ (এক্সট্রা ডিপার্টমেন্ট এজেন্ট), একজন ইডিএমসি (এক্সট্রা ডিপার্টমেন্ট মেইল ক্যারিয়ার) ও একজন ইডিডিএ (এক্সট্রা ডিপার্টমেন্ট ডেলিভারি এজেন্ট)। লোকজনের কাছে ইডিএরা পোস্টমাস্টার এবং ইডিএমসি ও ইডিডিএরা পিয়ন হিসেবেই বেশি পরিচিত। এসব শাখার মধ্যে কোথাও আবার চৌকিদার-ঝাড়ুদারও কর্মরত রয়েছেন। মাসের শেষে ইডিএ (পোস্টমাস্টার) ১২৬০ টাকা, ইডিএমসি ১২০০, ইডিডিএ ১১৭০ টাকা এবং চৌকিদার ও ঝাড়ুদাররা পান ৬৭৪ টাকা। ঈদ বা পূজায় তাদের ভাগ্যে কোনো বোনাস জোটে না। পান না সরকারি অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা। অথচ বছরের পর বছর এক পদে অভিন্ন বেতনে অনিশ্চিত অবস্থায় তারা কাজ করে যাচ্ছেন।
চলছে বদলে দেওয়ার চেষ্টা : ডাক বিভাগের বেহাল দশা নিয়ে কয়েক দফা যোগাযোগ করেও ডাক মহাপরিচালক নায়েব দেলোয়ার হোসেনের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে অতিরিক্ত মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র জানান, বর্তমান সরকার ডাক বিভাগকে গতিশীল করতে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন শুরু করেছে। তিনি বলেন, সাড়ে আট হাজার পোস্ট অফিসে প্রথম পর্যায়ে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। এসব পোস্ট অফিস আইটি সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এ ছাড়া ডাক বিভাগের এসএমএস মানি অর্ডার কার্যক্রম দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও ডাক বিভাগের কাজের পরিধি বাড়ানো হচ্ছে।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাড়ানো হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সেবা। এসব বাস্তবায়িত হলে আর্থিকভাবে সব পোস্ট অফিস লাভের মুখ দেখবে বলে আশা করেন ডাক বিভাগের এই অতিরিক্ত মহাপরিচালক। এদিকে ডাক অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, প্রবাসীদের অর্থ দেশে পৌঁছানো, মোবাইল ফোনে অর্থ স্থানান্তর, পাসপোর্টের আবেদনপত্র ও অর্থ জমা, সঞ্চয়ী হিসেবে অর্থ জমা রাখা, বাজারে প্রাইজবন্ড ছাড়া, অনুমিত আয়কর জমা, মোটরগাড়ি ও টেলিফোন বিল জমা, রাজস্ব স্ট্যাম্প বিক্রি পোস্ট অফিসের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর