বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

বিটিসিএলের হাতে হারিকেন

গ্রাহক সেবা নেইপদে পদে হয়রানি আর দুর্নীতি

বিটিসিএলের হাতে হারিকেন

কোম্পানি হওয়ার পর থেকেই ক্রমাগত লোকসানে বিটিসিএলের হাতে হারিকেন ধরা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রীয় এ টেলিফোন সংস্থাটিতে গ্রাহক সেবার কোনো বালাই নেই, আছে পদে পদে হয়রানি আর দুর্নীতির সীমাহীন বেড়াজাল। ফি-বছর লোকসান গুনলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঋণের টাকায় বোনাস গ্রহণে ব্যস্ত থাকেন সর্বদা। এর মধ্যেও চলে লুটপাটের নানা দৌরাত্ম্য। 

জানা গেছে, সেবা না পাওয়ায় বিটিসিএল থেকে ল্যান্ডফোনের গ্রাহকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বিটিসিএল সূত্রে জানা যায়, মোবাইল ফোনের জোয়ারে এখন ল্যান্ডফোনের দুর্দিন চলছে, গ্রাহকই পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থনৈতিকভাবে বিটিসিএল কোণঠাসা হয়ে পড়ার পেছনে এটি একটি বড় কারণ। দফায়-দফায় সংযোগ ফি, লাইন রেন্ট, কলরেট কমিয়েও নতুন গ্রাহক সংগ্রহে আশানুরূপ সাড়া মিলছে না। বরং মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে ল্যান্ডফোনের ব্যবহার কমতে-কমতে তলানিতে এসে  ঠেকেছে। নতুন গ্রাহক না বাড়ায় রাজস্বও কমে গেছে। এ কারণে ধীরে ধীরে ধসের মুখে পতিত হচ্ছে বিটিসিএল। 

স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন বোর্ড (বিটিটিবি)। এরপর ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ বোর্ডকে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডে (বিটিসিএল) রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়, যা বাস্তবায়িত হয় ২০০৮ সালের ১ জুলাই। প্রতিষ্ঠার পর প্রথম বছর লাভের মুখ দেখলেও এর পর থেকে ধারাবাহিক লোকসানের মুখে রয়েছে সংস্থাটি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন-ভাতা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে। এদিকে অধিদফতর না হওয়ায় বিটিসিএলে কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন সংস্থাটির প্রকৌশলীরা, ঝুঁকছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দিকে। উপরন্তু, কোম্পানি হওয়ায় টেলিকম ক্যাডার সার্ভিসের কাউকে নিয়োগও দেওয়া যাচ্ছে না। ছয় বছরেও সরকার একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারেনি। নাম পরিবর্তন ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির অন্য কোনো পরিবর্তন আসেনি। কোম্পানি আইনে যে সব নিয়ম-কানুন রয়েছে, বিটিসিএলে সেগুলো রয়েছে শুধু কাগজে। সেবার মান বাড়ানোর যে লক্ষ্য নিয়ে সরকার বিটিসিএলকে কোম্পানি করেছিল, সে লক্ষ্যও পূরণ হয়নি। টিআইবি জানিয়েছে, যথাযথ কর্মপরিকল্পনার অভাবে বিটিসিএল অকার্য?কর ও অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক সেবা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। টিআইবির অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা ও নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিটিসিএলের আয় কমে গেছে। সংস্থাটিতে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদায়ন, জবাবদিহির অভাব, অবৈধভাবে কোম্পানির ভূমি দখল, প্রাইভেট কোম্পানিকে অবৈধ সুবিধা দেওয়া, সিবিএ নেতাদের দুর্নীতি, গ্রাহকদের কাছ থেকে অবৈধ অর্থ আদায় ও পরিবহন খাতে দুর্নীতি হচ্ছে। বাজার ও চাহিদা বিবেচনায় না এনে ২৫টি কোম্পানিকে আইজিডব্লিউ লাইসেন্স প্রদান করার কারণে বিটিসিএলের আন্তর্জাতিক ইনকামিং কলসংখ্যা কমে গেছে। ২০১০ সালে ইনকামিং কলসংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫৭ কোটি মিনিট, যা ২০১৩ সালে এসে দাঁড়ায় প্রায় ২০৯ কোটি মিনিটে। কল রেকর্ড না থাকার কারণে বিটিসিএল রাজস্ব হারানোসহ মোট ১৫০০ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অন্যদিকে, বেআইনিভাবে বিটিসিএলের গেটওয়ে ব্যবহারের মাধ্যমে অবৈধ ভিওআইপি চালিয়ে যাওয়ায় বিটিসিএল বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। ‘কোম্পানি’ করতে এর জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট কৌশল ছিল না। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পতিত ‘বিটিসিএল’ এরই মধ্যে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।  

এক সময়ে একটি ল্যান্ড টেলিফোন পেতে তদবির ও টাকা ছাড়া কাজ হতো না। ছিল না ভোগান্তির কোনো শেষ। প্রায় চার লাখ টেলিফোন লাইন পড়ে থাকলেও এখন তা কেউ নিচ্ছে না। এখন বিটিসিএল ফ্রি দিয়েও গ্রাহক পাচ্ছে না। বিভিন্ন ক্ষমতাসম্পন্ন ডিজিটাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জগুলোর বেশির ভাগ অংশই অকেজো পড়ে থাকার কারণে বিটিসিএল তাদের ল্যান্ডফোন উপজেলা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে ফ্রি দিচ্ছে। কোনো সংযোগ ফি নেওয়া হচ্ছে না। তারপরও মানুষ নিচ্ছে না। দেখা যায়, টেলিফোন চললেও বিল দিতে হয় না গ্রাহকদের! মাস গেলেও বিলের কাগজ হাতে পান না গ্রাহকরা। উত্তরায় গত তিন-চার মাস কোনো বিল  দেয়নি বিটিসিএল। জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির বিলের মেশিন দীর্ঘদিন অকেজো পড়ে আছে। তাই বিলও দেওয়া হচ্ছে না। একই অভিযোগ রাজধানীর আরও বেশকিছু এলাকা থেকে পাওয়া গেছে। রাজধানীর অনেক এলাকায় তিন-চার মাস কোনো বিলের কাগজ দেয়নি বিটিসিএল। উত্তরার বাসিন্দা হামিদা আক্তার মুক্তা বলেন, চার মাস কোনো বিল পাননি। বিটিসিএল উত্তরা অফিসের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, বিল দেওয়ার মেশিনটি নষ্ট হয়ে আছে। মেশিন ঠিক হলে সব বিল একসঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। বিলের মেশিন না চললেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলবাজি আর ট্রেড ইউনিয়ন চলছে বেশ জোরেশোরে। শুধু হাজিরা খাতায় সই করে কেউ কেউ বেরিয়ে পড়ছেন রাজনীতি করতে।
এর আগে জাতীয় সংসদে ডাক, টেলিযোগাযোগ, তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি মন্ত্রী জানান, বিটিসিএল ২০১২-১৩ অর্থবছরে অপারেটিং লোকসানের পরিমাণ ছিল ৬০২ কোটি ৯০ লাখ টাকা। গত অর্থবছরে বিটিসিএল অপারেটিং লোকসান দিয়েছে ৫৪৪  কোটি টাকা। অন্যদিকে এফডিআর ভাঙিয়েছে ৪২০  কোটি টাকার। ২০১১-১২ অর্থবছরে বিটিসিএল আয় করেছিল ২ হাজার ১৮৬  কোটি টাকা। এর আগের বছর আয়ের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। তবে কোম্পানি হওয়ার পর প্রথম বছরে ২০০৮-০৯ বিটিসিএলের আয়-ব্যয়ের মধ্যে একটি ভারসাম্য ছিল। ওই বছর ১ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৬২২ কোটি টাকা। বেসরকারি  কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ক্রমাগত লোকসানের বোঝা টানছে বিটিসিএল।
ফলে সংস্থাটির এফডিআর ভাঙিয়ে বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হচ্ছে। এদিকে, অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যমে ২০৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বিটিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাঈদ খান ও সদস্য মোহাম্মদ তৌফিকসহ ১৪ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। একই সঙ্গে ৬টি ক্যারিয়ার কোম্পানির বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর