বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা
তদন্ত চায় শুল্ক গোয়েন্দারা

আটক সোনা কী হয়, কোথায় যায়

আটক সোনা কী হয়, কোথায় যায়

চোরাচালানের পথে আটক হওয়া সোনার কী হয়? জনমনের এমন প্রশ্নের জবাব দিতে এবার উদ্ধার হওয়া সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রার বিষয়ে তদন্ত চায় সরকারের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। সংস্থাটির তথ্যমতে, গত বছর ১ জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত ৬৭৭ কেজি সোনা উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দা। এই সময়ে ৮৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের একটি বড় অংশই বিমানবন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারী। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বাংলাদেশ প্র্রতিদিনকে বলেন, তদন্ত হলে সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রার আটক-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে স্বচ্ছতা বাড়বে। একই সঙ্গে জনমনে যদি কোনো অমূলক ধারণা থাকে তাও দূর হবে।  

জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে আটক সোনার চালান নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা করা হয়। কিন্তু এ নিয়ে জনমনে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে। কেউ কেউ বিভিন্ন টকশোয় প্রশ্ন তুলেছেন এসব সোনা তছরুপ হয় কি না? এমনকি এনবিআরের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) সাবেক একজন চেয়ারম্যানও প্রশ্ন তুলেছেন আটক সোনার হিসাব-নিকাশ নিয়ে। এমন প্রেক্ষাপটে গত বছর ১ জুলাই থেকে সর্বশেষ আটক হওয়া সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে তদন্ত কমিটি করতে এনবিআরের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা। সংস্থাটির মহাপরিচালক ড. মইনুল খান স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত পত্রে বলা হয়- গত বছরের জুলাই থেকে দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিপুল পরিমাণ সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। এতে এনবিআরের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। এসব সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা সংশ্লিষ্ট কাস্টমস হাউসের গুদাম এবং পরবর্তীতে বিধি মোতাবেক পুলিশ প্রহরায় বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা করা হয়। তবে আটক হওয়া এই বিপুল পরিমাণ সোনার কী হয়, তা নিয়ে গণমাধ্যম ও জনসাধারণের মধ্যে অস্বচ্ছ ধারণা বিরাজ করছে। কেউ কেউ মনে করেন আটকের পর এসব সোনার আর কোনো হিসাব থাকে না। তছরুপ হওয়ার আশঙ্কাও ব্যক্ত করা হয়। টেলিভিশনগুলোর টকশোয়ও প্রশ্ন তোলা হয়। প্রচলিত এই ধারণা সামনে রেখে বিভিন্ন সময়ে আটক সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা যথাযথভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা প্রদান বিষয়ে সামগ্রিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে শুল্ক গোয়েন্দা।   

এই তদন্ত কমিটিতে কাদের রাখা যেতে পারে- এমন প্রস্তাব দিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা বলেছে, সংশ্লিষ্ট কাস্টমস হাউস, কমিশনারেটের যুগ্ম-কমিশনার পর্যায়ের কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের সহকারী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট রাজস্ব বিভাগের সহকারী পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে এই তদন্ত কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এই কমিটি গত বছরের জুলাই থেকে হালনাগাদ পর্যন্ত যেসব সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা আটক হয়েছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা প্রদান হয়েছে কি না এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কী প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তি হয়েছে, সে বিষয়ে এনবিআরকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। এ ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি আটক সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রার প্রতিটি বিভাগীয় মামলাভিত্তিক নম্বর, তারিখ, সংশ্লিষ্ট কাস্টমস হাউস বা কমিশনারেটে জমা হওয়ার নম্বর ও তারিখ, বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা প্রদানের নম্বর ও তারিখ অনুযায়ী সোনা ও মুদ্রার নিষ্পত্তির তথ্য পর্যালোচনা করতে পারে। একই সঙ্গে যে আদেশ মোতাবেক বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, তার তথ্য, অনিষ্পন্ন থাকলে কী কারণে অনিষ্পন্ন রয়েছে সেই তথ্যসহ অন্যান্য বিষয় পর্যালোচনা করার প্রস্তাব দিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিপুল অঙ্কের লাভের কারণে চোরাকারবারিরা সোনা চোরাচালানে যুক্ত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাফিয়ারা বাংলাদেশকে চোরাচালানের নিরাপদ ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে। এখন মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও সোনা আসছে ইউরোপের কয়েকটি দেশ থেকে। আকাশপথে সোনার চালান এনে তা সহজেই আবার স্থলপথে পাচার করছে পাশের দেশ ভারতে। ভৌগোলিক অবস্থান ও নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে আন্তর্জাতিক সোনা চোরাকারবারিরা বাংলাদেশকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আকাশ ও স্থল পথে সোনা চোরচালান হয়ে আসছে বাংলাদেশে। জানা গেছে, আশির দশকে এ দেশে চোরাচালানের মাধ্যমে সোনা আসা শুরু হয়। ১৯৮৫ সালে চোরাচালানের ৯৬ কেজি ৫২৫ গ্রাম সোনা উদ্ধার করা হয়। সোনার বারগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা হয়। ওই বছরই সোনা চোরাচালানের অভিযোগে ২৬টি মামলায় ৩১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৮৬ সালে উদ্ধার করা হয় ১২০ কেজি ২২৫ গ্রাম সোনা। ওই বছর সোনা চোরাচালানের অভিযোগে ৩৮ জনের বিরুদ্ধে ৩৮টি মামলা হয়। সেই সময় থেকে বছর গেছে আর সোনার চোরাচালান বেড়েছে। ২০১৪ সালে এসে শত শত কেজি সোনার বার পাচার হচ্ছে। সূত্রমতে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে চোরাচালান হওয়া সোনা মিয়ানমার ও মালয়েশিয়া থেকে ট্রলারযোগে কক্সবাজার এবং টেকনাফে আনা হয়। এ ছাড়া ঢাকার শাহজালাল, চট্টগ্রামের শাহ আমানত ও সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমে সোনা আসছে। এই তিনটি বিমানবন্দরকে চোরাচালানের স্বর্গদ্বার হিসেবে ব্যবহার করছে সোনা চোরাকারবারিরা। এ ছাড়া দেশের সীমান্তের বেশ কয়েকটি পয়েন্ট নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব রুট দিয়ে চালান সরাসরি ভারতীয় সোনা চোরাকারবারিদের হাতে চলে যায়। একটি চালান নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে পাচারকারী সিন্ডিকেটকে ঘাটে ঘাটে টাকা গুনতে হয়। তবেই কাক্সিক্ষত চালান হাতে পায় পাচারকারীরা। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে সোনা পাচারকে কেন্দ্র করে। সিন্ডিকেটে বাংলাদেশের কিছু প্রভাবশালী রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও গোয়েন্দা সংস্থার অসাধু কর্মকর্তাদের সরাসরি যোগসাজশ রয়েছে। সিভিল অ্যাভিয়েশনের নিরাপত্তা বিভাগ, কাস্টমস ও বাংলাদেশ বিমানের শতাধিক কর্মী টাকার বিনিময়ে পাচারকারীদের সহায়তা করছেন। মাঝেমধ্যে বিমানবন্দরে কর্মরত এসব লোক সোনা চোরাচালান করতে গিয়ে ধরা পড়ছেন। অথচ মূল হোতারা বিদেশে বসেই তাদের এজেন্ট দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাই ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন তারা।

সর্বশেষ খবর