বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা
মধ্যরাতের কারওয়ান বাজার

রাত গভীর হয়, পাল্লা দিয়ে বাড়ে টাকার খেলা

রাত গভীর হয়, পাল্লা দিয়ে বাড়ে টাকার খেলা

রবিবার রাত সোয়া ১টা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ওয়াসা ভবনের উল্টো দিকের কাজী নজরুল ইসলাম সরণি। ভিআইপি এই সড়কে রীতিমতো মালবোঝাই ট্রাকের বহর। গভীর রাতেও সৃষ্টি হয়েছে যানজটের। এ সুযোগে তৎপর হয়ে উঠেছে ওতপেতে থাকা কারওয়ান বাজারের বিচ্ছুর দল বা ‘থাবা পার্টি’র সদস্যরা। এদের বয়স ৮ থেকে ১৬ বছর। বড়জোর ২০। প্রত্যেকের হাতেই লুকানো রয়েছে ব্লেড। যানজটের কারণে আটকে থাকা সবজি-মুরগি কিংবা মাছবোঝাই পিকআপে হানা দিচ্ছে ওরা। ট্রাকের ওপর লাঠি নিয়ে প্রহরায় লোক থাকার পরও ওদের নিবৃত্ত করতে পারছে না। থাবা পার্টির সদস্যরা ছিনিয়ে নিচ্ছে মুরগি, মাছ, ফলমূল-সবজি। ছিনিয়ে নেওয়া মালগুলো নিয়ে জমা করছে ভিআইপি সড়ক লাগোয়া ভবনগুলোর ভিতরে। থাবা পার্টিরই এক সদস্য রাসেল। কিছুক্ষণ আগেই সে মাছবোঝাই একটি ট্রাক থেকে বড় একটি মাছ ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে। কথা বলতে চাইলে এ প্রতিবেদককে বলে, ‘ভাই পেটের দায়ে এই কামে নামছি। আমরা তো ছিনতাই করি না। হাতে ব্লেড রাখি ড্রামের ওপর জালি কাটার জন্য।’ ভুক্তভোগী কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ দৃশ্য নিত্যদিনের। প্রতিদিনই রাত ১২টা থেকে টানা ৩টা পর্যন্ত চলে এ অবস্থা।  

থাবা পার্টির ব্যাপারে কথা বলতে গেলেই বিপদ। ওদের সিন্ডিকেট অনেক বড়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু থাবা পার্টি নয়, কারওয়ান বাজারের সব ধরনের বিষয়েই পুরোপুরি অবগত সংশ্লিষ্ট থানা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। তবে রহস্যজনক কারণেই তারা নীরব। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কারওয়ান বাজারে বেড়ে চলে টাকার খেলা। এর বড় একটি অংশ পৌঁছে যাচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্য ও প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে। রাত ১০ টার পর থেকেই কারওয়ান বাজারে চলে প্রকাশ্য চাঁদাবাজি। সাতটি পয়েন্টে প্রকাশ্যেই চাঁদা ওঠানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। এরই মধ্যে বিভিন্ন পয়েন্টে চলে ট্রাক আনলোড, পিকআপ লোড এবং পণ্য কেনাবেচার খেলা। ট্রাকের পণ্য ওঠাতে ভ্যানচালকদের যুদ্ধ। এ যেন বিশাল কর্মযজ্ঞ। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতেও কষ্ট হবে অনেকের। আবার মার্কেটের বাইরে আড়তের জায়গাকে ঘিরে চলে বিশাল বাণিজ্য। একটি সংঘবদ্ধ চক্র প্রতিদিনই এ চাঁদা উঠায়। চাঁদাবাজদের হাত থেকে রেহাই নেই রিকশা, ভ্যান, পিকআপ কিংবা ট্রাক চালকের। সাতটি পয়েন্টের যে কোনো দিক দিয়ে বের হতে চাইলেই দিতে হবে নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা। রাত ১০টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত প্রতিদিন চলে এ কর্মযজ্ঞ। প্রতিটি ট্রাক থেকে তোলা হয় ৩০ থেকে ৫০ টাকা, পিকআপ ২০ টাকা, রিকশা ও ভ্যান ৫ টাকা। জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন মাছ, সবজি, ফল বোঝাই অন্তত ৭০০ ট্রাক ঢোকে কেবল কারওয়ান বাজারে। আর এসব ট্রাকে করে নিয়ে আসা পণ্য খুচরা ব্যবসায়ীরা পিকআপ, রিকশা কিংবা ভ্যানে করে নিয়ে যান মহানগরীর অন্যান্য বাজারে। কারওয়ান বাজারের লাভিঞ্জি হোটেলের সামনে পিকআপ, ভ্যান, রিকশা থেকে চাঁদা তোলার দায়িত্বে থাকা কর্মী সুমনের (ছদ্মনাম) সঙ্গে কথা বলতেই তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভাই আমরা তো কেউ না। আমারে বেতন দেয়, আর ট্যাহা তুইল্যা হেগো দিয়া দেই। শ্রমিক লীগের মোস্তফা ও মিজানের হুকুম ছাড়া কারওয়ান বাজারের কিছু অয়? আগে করত বিএনপির লোকেরা। এহন হেগো পাত্তাও নাই।’
রাত সোয়া ২টা। কারওয়ান বাজারের বিপরীতে প্রজাপতি গুহা আন্ডারপাস লাগোয়া ফুটপাতে চোখে পড়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ফুটপাতের ওপরই শুয়ে আছেন শতাধিক নারী-পুরুষ। বিএসইসি ভবনের ঠিক বিপরীত পাশের ফুটপাতে শুয়ে থাকা এক বৃদ্ধের দিকে চোখ পড়ল। বাঁশের টুকরির ওপরই জড়সড় হয়ে শুয়ে আছেন তিনি। শীর্ণ শরীর। বয়স আনুমানিক ৬৫। ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছিলেন না। বুঝতে বাকি রইল না তিনি অ্যাজমা রোগী। শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে তার অনেক কষ্ট হচ্ছে। ইট-পাথরের এই নগরীতে মাথা গোঁজার মতো কোনো ঠাঁই না থাকায় সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর তিনি তার টুকরির ওপরই বাধ্য হয়ে শুয়ে আছেন। তার একটু দূরেই আনুমানিক দেড় বছর ও তিন বছরের দুই শিশুকে ধরে শুয়ে আছেন এক মা। ওই ফুটপাতে শুয়ে আছেন প্রায় অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ। এদের বেশির ভাগই সারা দিন খাটুনির পর সেখানেই শুয়ে পড়েন বলে জানা গেল। ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিল সুমন (১৪) নামে এক কিশোর। পেশায় টোকাই। সারা দিন এটাওটা কুড়িয়ে বিক্রি করে মেলে ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা। তবে ওই টাকার বড় একটা অংশ দিয়ে সে গাঁজা সেবন করে বলে জানিয়েছে এই প্রতিবেদককে। রাত আড়াইটা। পেট্রোবাংলা ও বিটিএমসি ভবনের মাঝামাঝি। পণ্য আনলোড করে এক একটি ট্রাক বের হতেই শূন্যস্থান পূরণ করছে অন্য একটি ট্রাক। এই ট্রাকটিকে টার্গেট করে ভ্যান নিয়ে ভ্যানচালকদের জীবনপণ দৌড়। যিনি আগে ট্রাকের গায়ে ভ্যান ঠেকাতে পারবেন, তিনিই ট্রাকের বস্তা ভ্যানে তুলতে পারবেন। ওই ট্রাককে ঘিরে ভ্যানগুলো নেমে যায় আদিম প্রতিযোগিতায়। এ প্রতিযোগিতাকে যুদ্ধ বলাই শ্রেয়। 

মাদকের আখড়া : কারওয়ান বাজারের রেল লাইন লাগোয়া ফলপট্টি ও কামারপট্টি এলাকায় যাওয়ামাত্র চোখে পড়ে ভিন্ন চিত্র। নিত্যদিনের এই দিনলিপির বাইরেও চলে আরও অনেক কাজ, অনেক খেলা, অনেক লীলা। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা জেগে থাকা অংশও আছে এই বাজারের রেল লাইনে। প্রতিক্ষণ, প্রতি মূহূর্ত এ রেল লাইনে চলে নেশার বেচাকেনা, এক মুহূর্তের জন্যও তা স্তব্ধ হয় না। প্রায় ৫০-৬০ জন ভ্রাম্যমাণ মাদক বিক্রেতার আনাগোনা সেখানে। তাদের খোঁজ নিচ্ছে মাদকসেবীরা। ফল ব্যবসায়ী রাসেল আহমেদ জানালেন, রাজধানীর কোথাও মাদক পাওয়া না গেলে কারওয়ান বাজারে পাওয়া যাবেই। রেল লাইনটি ঘিরে একই তালে জেগে থাকে তেজগাঁও আর শিল্পাঞ্চল এ দুই থানার পুলিশ সদস্যদের ‘অর্থমুখী’ চোর-পুলিশ খেলা, তাতে লাভ হয় চোর-পুলিশ তথা মাদক বিক্রেতা-পুলিশ উভয় পক্ষেরই; যা যায় সবটুকুই খুচরা নেশাদ্রব্য ক্রেতাদের পকেট থেকে। 

ফিরে দেখা : যত দূর জানা যায়, সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই এখানে বাজার চলছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে কারওয়ান সিং নামের একজন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী এখানে প্রথম পাইকারি বেচাকেনার একটি মার্কেট খোলেন। তার নামেই এ বাজারের নামকরণ হয়েছে। গোটা শহর যেভাবে জেগে ওঠে কিংবা ঘুমুতে যায়, কারওয়ান বাজার চলে তার ঠিক উল্টো রীতিতে। কারওয়ান বাজারের ঘুম ভাঙে সকালে নয়, সন্ধ্যার পর। এখন অবশ্য পাইকারি বাজারের খোলস ছেড়ে বের হয়ে এ এলাকা ‘মিডিয়াপাড়া’ খ্যাতি লাভ করেছে। গত দুই দশকে এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অনেক গণমাধ্যমের কার্যালয়। বড় বড় পত্রিকা আর টিভি-রেডিও অফিসের কল্যাণে কাঁচাবাজারের বাইরেও কারওয়ান বাজার পেয়েছে নতুন পরিচয়।

সর্বশেষ খবর