শনিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা
মংলা বন্দর

ছাড়পত্র ছাড়াই জাহাজ চলাচল

কারিগরি পরীক্ষা তিন বছর ধরে বন্ধ

মংলা বন্দর দিয়ে ছাড়পত্র বা এনওসি ছাড়াই অবাধে জাহাজ চলাচল করছে। জাহাজের কারিগরি পরীক্ষা কার্যক্রম প্রায় তিন বছর বন্ধ থাকার কারণে এ ঘটনা ঘটছে। বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এ কারণে গত ৩৪ মাসে ৮২০টি জাহাজ পরীক্ষা না করায় বন্দর কর্তৃপক্ষ ৮২ লাখ টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, মংলা বন্দর নৌবাণিজ্য অফিসে কোনো কর্মকর্তা না থাকায় কারিগরি পরীক্ষা ছাড়াই একজন নিুমান সহকারী (কেরানি) শুধু জাহাজের নাম-ঠিকানাসহ প্রয়োজনীয় তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করে ‘অনাপত্তির সনদ’ দিচ্ছেন। এর ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মংলা সমুদ্রবন্দর। সূত্র জানায়, এ কারণে গত ১২ সেপ্টেম্বর এক হাজার টন সিমেন্টবোঝাই ‘এভি হাজী-১’ নামের একটি অভ্যন্তরীণ কার্গো জাহাজ মংলা বন্দরে ডুবে যায়। এ ছাড়া বন্দর সীমানায় অভ্যন্তরীণ জাহাজের প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও ‘অনাপত্তির সনদে’ এমভি হাজী-১-কে সমুদ্রগামী দেখানো হয়েছিল। এ ছাড়া একই কারণে গত ১১ সেপ্টেম্বর পানামার পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি সিনো গ্রেস’ মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এর আয়তন কম দেখিয়ে মংলা বন্দরে প্রবেশ করে। পরে বন্দর কর্তৃপক্ষ পরিমাপ করে এটির আয়তন অনেক বেশি পায়। বন্দর ও শুল্ক বিভাগের প্রাপ্য রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার জন্যই অনেক জাহাজের আয়তন ও ধারণ ক্ষমতা কম দেখানো হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সমুদ্রগামী জাহাজ চলাচল আইন ‘মার্চেন্ট শিপিং অর্ডিন্যান্স (এমএসও)-১৯৮৩’ অনুযায়ী, সমুদ্রবন্দরে জাহাজ প্রবেশ ও ত্যাগের আগে জাহাজটির নিরাপত্তাসংক্রান্ত এনওসি বা ছাড়পত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বন্দরের নিরাপত্তার স্বার্থে জাহাজটি ঝুঁকিমুক্ত কিংবা নিরাপদ কিনা- তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্যই এই ব্যবস্থা। এনওসি বাবদ প্রতিটি জাহাজের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা পেয়ে থাকে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ‘পোর্ট স্টেট কন্ট্রোল’ বা পিএসসির আওতায় নৌবাণিজ্য অফিসের একজন কারিগরি বিশেষজ্ঞ (প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক/নটিক্যাল সার্ভেয়ার) এই দায়িত্ব পালন করেন। তবে ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এখানকার নৌবাণিজ্য অফিসে কোনো কর্মকর্তা নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন কে এম জসিমউদ্দিন সরকার ২০০৯ সালের ৪ জানুয়ারি সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ারের (সিএনএস) চলতি দায়িত্ব পাওয়ায় ছয় বছর ধরে ঢাকায় অবস্থান করছেন। আর প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক শফিকুল ইসলামকে প্রথম দফায় ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি অধিদফতরের নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ে প্রকৌশলী ও জরিপকারক পদে এবং সেখান থেকে ২০১৩ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামে নৌবাণিজ্য অধিদফতরে মুখ্য কর্মকর্তার সাময়িক দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফলে মংলা বন্দরে আসা জাহাজসমূহের নিরাপত্তাবিষয়ক কারিগরি পরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত নৌবাণিজ্য অফিস খুলনার এ সংক্রান্ত কার্যক্রম ৩৪ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। এদিকে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ১ জানুয়ারি-২০১২ থেকে চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৩৪ মাসে এখানে আগত জাহাজের সংখ্যা ৮২০টি। এর মধ্যে চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ৩১৫টি, ২০১৩ সালে ৩০৩টি এবং ২০১২ সালে ২০২টি জাহাজ এসেছে মংলায়। জাহাজপ্রতি ১০ হাজার টাকা হিসেবে ৮২০টি জাহাজের বিপরীতে সরকার ৮২ লাখ টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। নৌবাণিজ্য অফিসে কোনো কর্মকর্তা না থাকায় সেখানকার নিুমান সহকারী আবুল খায়ের বন্দরে আসা জাহাজের নাম-ঠিকানাসহ প্রয়োজনীয় তথ্য লিপিবদ্ধ করে ‘অনাপত্তির সনদ’ দিলেও কারিগরি পরীক্ষা না করার কারণে জাহাজগুলোর কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া জনবল সংকটের কারণে ওই অফিসের বন্দর-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রমও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সূত্র জানায়, নৌবাণিজ্য অফিসের জন্য গত বছর উচ্চমান সহকারী, কম্পিউটার অপারেটর ও স্টেনোগ্রাফারসহ ছয়জন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ এক বছরেও তাদের এখানে পদায়ন দেওয়া হয়নি। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক ওই ছয়জনকে খুলনায় পদায়নের জন্য ইতিমধ্যে অফিস আদেশ জারি করলেও নৌবাণিজ্য অধিদফতরের মুখ্য কর্মকর্তা তাদের চট্টগ্রামে রেখে দায়িত্ব পালন করাচ্ছেন।  এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গতকাল সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক জাকিউর রহমান ভুঁইয়ার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার অফিস থেকে জানানো হয়, ‘আন্তর্জাতিক নৌ-সংস্থার একটি সভায় যোগদানের জন্য তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন।’ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী ও মহাপরিচালকের সাময়িক দায়িত্বপ্রাপ্ত এ কে এম ফখরুল ইসলাম জানান, ‘মহাপরিচালক সরকারি সফরে দেশের বাইরে অবস্থান করায় আমি তার রুটিন দায়িত্ব পালন করছি। এ ছাড়া প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে আমি অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল বিষয় তদারকি করে থাকি। সমুদ্রগামী জাহাজ চলাচল সম্পর্কে অফিসিয়ালি কিছু বলা আমার এখতিয়ারবহির্ভূত।’

সর্বশেষ খবর